দখল, দূষণ, ভরাট,বর্জ্য ও নর্দমার পানিতে বর্তমানে রাজধানী ঢাকার ২৬টি খাল প্রায় মৃত অর্থাৎমুমূর্ষু। ফলে একটু বৃষ্টি হলেই নর্দমার বর্জ্যপানিতে ভাসে রাজধানী ঢাকার রাস্তাঘাট-অলিগলি। যদিও ১৯৮৯ সালে ঢাকা ওয়াসাকে নর্দমা ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। পানি নিষ্কাশন স্বাভাবিক রেখে জলাবদ্ধতার হাত থেকে নগরবাসীকে রক্ষা করা হলো নর্দমা ব্যবস্থাপনার অন্যতম দায়িত্ব। আর রাজধানীতে পানি নিষ্কাশন হয় নগরীর খালগুলো দিয়ে। কিন্তু ১৯৮৯ সাল থেকে এখন অব্দি এই ৩১ বছরেও খাল রক্ষায় তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি ঢাকা ওয়াসা।
তবে ঢাকা ওয়াসাকে এ দায়িত্ব প্রদান করা হলেও নগরীর নর্দমা ব্যবস্থাপনার বৃহৎ অংশের দায়িত্ব মূলত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের। এর আগে ঢাকার দুই সিটি মেয়র কয়েকবার ওয়াসার খাল নিজেদের তত্ত্বাবধানে নিতে আগ্রহ দেখিয়েছেন।
আজ রবিবার (১১ অক্টোবর, ২০২০) স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং দুই সিটি করপোরেশনের মেয়রের বৈঠক রয়েছে।
সম্প্রতি রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) জরিপের তথ্যানুযায়ী ঢাকার ২৬টি খালের মধ্যে ৭টির সরাসরি সংযোগ রয়েছে নদীর সঙ্গে। এর মধ্যে রয়েছে আব্দুল্লাহপুর খাল, বেগুনবাড়ী খাল, দ্বিগুণ খাল, হাজারীবাগ খাল, জিরানী খাল, কল্যাণপুর খাল ও মাণ্ডা খাল। রূপনগর খাল, শাহজাদপুর খাল ও সুতিভোলা খাল এই তিনটি জলাধারের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। বাকি ১৬টি খাল ওই ১০টি খালের সঙ্গে যুক্ত। তবে খাল নিয়ে ঢাকা ওয়াসার তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই।
আরডিআরসি এর তথ্যমতে আরও জানা যায় যে, আব্দুল্লাহপুর খালটির উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টরের কামারপাড়া মৌজার ওপর পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি স্লুইস গেট রয়েছে। এ ছাড়া খালটির ওপর ভবনের অবৈধ দেয়াল ও মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে।
দিয়াবাড়ী খালের সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে সংযোগ বিচ্ছিন্ন। এ ছাড়া ছোট আকৃতির সেতু ও কালভার্ট নির্মাণের মাধ্যমে এর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। ওয়াসার কাগজে সাত হাজার ৬০০ মিটার খালটির বর্তমান দৈর্ঘ্য ছয় হাজার ৫২১ মিটার।
বেগুনবাড়ী খালটি রমনা কালভার্ট থেকে শুরু হয়ে মেরাদিয়া হয়ে বালু নদীতে পড়েছে। খালটিতে দূষণ কম থাকলেও ওয়াসার দেওয়া দৈর্ঘ্যের চেয়ে ২০০ মিটার কম রয়েছে।
দ্বিগুণ খালের ওপরও একটি স্লুইস গেট রয়েছে। বর্তমানে খালটির ৭০০ মিটার দখল করেছে রাজউক। তবে বিকল্প পথে খালের প্রবাহ সচল রয়েছে। খালটির দৈর্ঘ্য চার হাজার ৫৭০ মিটার থাকার কথা থাকলেও রয়েছে তিন হাজার ৮০২ মিটার।
তুরাগ নদের সঙ্গে যুক্ত রূপনগর খালের দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০০ মিটারের মতো কম। খালটিতে অবৈধ পাইপলাইন বসানো হয়েছে। প্রবাহ নেই বললেই চলে। সরাসরি নদীর সঙ্গে যুক্ত হাজারীবাগ খালটির আশপাশে ভাসমান ও অস্থায়ী বাজার রয়েছে। ফলে বর্জ্যে প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
নড়াই নদীর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত জিরানী খালটির দৈর্ঘ্য চার হাজার ৪৫০ মিটার। কিন্তু বর্তমানে এর দৈর্ঘ্য দুই হাজার ৯৬০ মিটার। নন্দীপাড়া এলাকায় খালটির ওপর অবৈধ বাজার রয়েছে। খালটি বর্জ্যে দূষিত। কল্যাণপুরে ছয়টি খাল রয়েছে। এর মধ্যে কল্যাণপুর মূল খালের পূর্বপাশে কচুরিপানা ও দুর্গন্ধযুক্ত বর্জ্যে ঠাসা। বিভিন্ন কম্পানি ও ব্যক্তি খালটির জায়গা দখল করে বাড়ি ও হাটবাজার বসিয়েছে।
মদিনাবাগ-মুগদা চার খালের মুখ থেকে শুরু হয়ে মাণ্ডা খাল সরাসরি নদীতে পড়েছে। পাশের শাপলা হাউজিংয়ে যাতায়াতের জন্য খালটির ওপর আড়াআড়ি রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। গ্রিন মডেল টাউনের কাছে নির্মাণ করা হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্যের ভাগাড়। ওয়াসার তথ্যে খালটির দৈর্ঘ্য ছয় হাজার ৩৫০ মিটার। বর্তমানে বাস্তবে রয়েছে তিন হাজার ৭১৭ মিটার।
এর বাইরে কাটাসুর খালের ২১৩ নম্বর দাগে রাস্তা, ৬৬৯ নম্বর দাগে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের কবরস্থান নির্মাণে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। খাল ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে অবৈধ ট্রাক স্ট্যান্ড। খালটিতে নাব্যতা না থাকায় সেখানকার পানি অতিমাত্রায় দূষিত। এ খালটিতেও ওয়াসার দেওয়া তথ্যের চেয়ে দৈর্ঘ্য ৩৭৮ মিটার কম রয়েছে।
দখল দূষণে বিলীন হতে বসা বাইশটেকী খালের প্রবাহ ফেরাতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এ খালটির কারণে আশপাশের এলাকায় তীব্র জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতো। মিরপুর ১৪ নম্বর মোড় থেকে কালশী ব্রিজ হয়ে সাগুফতা হাউজিংয়ের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত দ্বিগুণ খালটি মিলিত হয়েছে বাউনিয়া খালের সঙ্গে। খালটির প্রবাহ সচল থাকলেও আশপাশের আবাসন কম্পানিগুলো খালটি দখল করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এর বাইরে দেবধোলাই খালটি ঢাকা-ডেমরা মহাসড়কের কাজলারপার থেকে শুরু হয়ে মাণ্ডা খালে পড়েছে। খালপারে জেলা পরিষদ প্রায় এক কিলোমিটার জায়গায় রাস্তা নির্মাণ করেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনও একটি রাস্তা নির্মাণ করছে। ফলে খালটি অত্যধিক সরু হয়ে পড়েছে। খালপারে রয়েছে অবৈধ স্থাপনাও।
ইব্রাহিমপুর খালটি পুরাতন বিমানবন্দর দেয়াল থেকে শুরু হয়ে মিরপুরের ইব্রাহিমপুর পুলপারে গিয়ে শেষ হয়েছে। খালপারের বাজার এবং বাড়ি থেকে খালটিতে সরাসরি বর্জ্য ফেলে বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
খিলগাঁও বাসাবো খালটি খিলগাঁও তিলপাপাড়া থেকে শুরু হয়ে মদিনাবাগ চার খালের মুখ পর্যন্ত বিস্তৃত। খালের পাশে রয়েছে ভাসমান বাজার। আর খালটিতে ফেলা হয় বাসাবাড়ির বর্জ্য। ফলে খালটিতে প্রবাহ নেই বললেই চলে। এখানেও ওয়াসার দেওয়া তথ্যের চেয়ে দৈর্ঘ্যে ৫০ মিটার কম রয়েছে।
মোহাম্মদী হাউজিংয়ের ৫ নম্বর রোড থেকে শুরু হয়ে মোহাম্মদপুর আদাবর ১৬ নম্বর রোড পার হয়ে কল্যাণপুর প্রধান খালে গিয়ে শেষ হয়েছে রামচন্দ্রপুর খাল। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ সমিতির বস্তি এবং সিটি করপোরেশনের রাস্তা বানানো হয়েছে খালটির জায়গা দখল করে। এ ছাড়া কাটাসুর ও রামচন্দ্রপুর খালের মুখে জাকের ডেইরি ফার্ম এবং একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। ওয়াসার তথ্যানুযায়ী, এ খালটির দৈর্ঘ্য দুই হাজার ৯৪০ মিটার হলেও বর্তমানে আছে দুই হাজার ১৩১ মিটার।
মিরপুর-১১ কালশী রোড থেকে শুরু হয়ে বাইশটেকী খালে মিলিত হওয়া সাংবাদিক কলোনি খালটির দৈর্ঘ্য দেড় হাজার মিটার। কিন্তু বাস্তবে আছে ৯৮৩ মিটার। খালটির অনেক জায়গা দখল করে নিয়েছে দখলবাজরা।বাজার ও বাসাবাড়ির বর্জ্যে নষ্ট করা হয়েছে সেগুনবাগিচা খাল। এ খালটির প্রবাহ বছরজুড়েই বন্ধ থাকে।
শাহজাদপুর খালটির ওপর ভাসমান ও অস্থায়ী বাজার রয়েছে। এ ছাড়া বাসাবাড়ির বর্জ্য ফেলা হয় খালটিতে। তবে সুতিভোলা খালটি সচল রয়েছে। এ খালটিতে বর্তমানে কোনো দখলদার নেই। তবে সাঁতারকুল এলাকায় খালটির মধ্যে ফেলা হয় বর্জ্য।
‘ওয়াসা আইনে নর্দমা ব্যবস্থাপনার’ বিষয়টি নেই দাবী করে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান জানান, এ ব্যাপারে সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে, আমরা তা মেনে নেব।’
আরডিআরসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘স্থায়ীভাবে ঢাকার খালগুলো সচল করা না গেলে জলাবদ্ধতার সমাধান মিলবে না। সরকারের উচিত এ বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া।’ সূত্র: কালের কণ্ঠ