ঘূর্ণিঝড় ইয়াস : ২৬ মে খুলনা উপকূলে আঘাত হানতে পারে
অনলাইন রিপোর্টার ॥ ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের অস্তিত্ব এখন নেই, তবে পূর্বাভাস আছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মাঝেই দু-একদিনের মধ্যে উত্তর আন্দামান সাগর ও তৎসংলগ্ন পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগরে (একটি লঘুচাপ আকারে সৃষ্টি হয়ে পরে এটি ঘূর্ণিঝড়ে) উৎপত্তি হতে পারে ‘ঘূর্ণিঝড় ইয়াস’।
‘দ্য ফ্রি প্রেস জার্নাল’ বলছে, ‘ইয়াস’আরবি শব্দ যার অর্থ হচ্ছে ‘মরিয়া অথবা ডেসপেয়ার বা হতাশা’ আর এর নামটি দিয়েছে ওমান। এবং শব্দটির উৎপত্তি পার্সি ভাষা থেকে। ইংরেজিতে একে বলা হয় ‘জেসমিন’। আর পার্সি ভাষায় Yass-এর উচ্চারণ ‘ইয়াস’।
মূলত ঘূর্ণিঝড়গুলোর নামকরণ করে মেটেরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন ও ইউনাইডেট নেশনস ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়ার সদস্য দেশগুলো। আর এ জন্য তেরো সদস্যের একটি প্যানেলও রয়েছে। এর সদস্য দেশগুলো হলো- ভারত, ইরান, মলদ্বীপ, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ওমান, পাকিস্তান, কাতার, সৌদি আরব, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইয়েমেন। সদস্য দেশগুলোর প্রত্যেকে প্রতিবছর ১৩টি করে নাম প্রস্তাব করে এবং সেখান থেকে নির্বাচিত নামের একটি তালিকা তৈরি হয় সবমিলিয়ে যার সংখ্যাটা ১৬৯। ওমান যেমন ইয়াস নাম দিয়েছে, তেমনই এর পরবর্তী ঘূর্ণিঝড়ের নামটা নেয়া হয়েছে পাকিস্তান থেকে। যার নাম গুলাব। তারপরেই আছে কাতার। তাদের দেওয়া সাইক্লোনের নাম শাহিন। এভাবেই ক্রমান্বয়ে সৌদি আরব, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ইয়েমেনের দেয়া ঝড়ের নামই ব্যবহার করা হবে।
এটি যদি ঘূর্ণিঝড়ে রূপান্তরিত হয় তবে এটির নাম হবে ইয়াস যা ২৫-২৬ মে নাগাদ ভারতের ওড়িশা-পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের খুলনা উপকূলের স্থলভাগে এটি আছড়ে পড়তে পারে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর (বিএমডি) এবং ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগ (আইএমডি) পৃথক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে যে, লঘুচাপটি ২২ মে-র মধ্যে সৃষ্টি হতে পারে যার ফলে সাগরে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়টি সৃষ্টি হতে পারে ২৫ মে। আবহাওয়া ব্যবস্থা অনুযায়ী এর আগে সাগরে একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হবে। পরে তা নিম্নচাপে পরিণত হবে, যা ৩য় ধাপে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হবে।
আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক জানায়, ওড়িশা থেকে বাংলাদেশের সুন্দরবন ও চট্টগ্রাম এলাকা পর্যন্ত ইয়াসের প্রভাব পড়তে পারে।
আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ জানান, ২২ থেকে ২৩ মে বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে। এসময় তা ক্রমান্বয়ে নিম্নচাপে রূপ নেবে। পরে এই নিম্নচাপ ধীরে ধীরে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে তবে ঘূর্ণিঝড়টি কোন কোন এলাকায় আঘাত হানতে পারে তা আরও কয়েকদিন পর সুস্পষ্টভাবে জানা যাবে।
বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ দেশি-বিদেশি সব আবহাওয়া সংস্থার আশঙ্কা, বঙ্গোপসাগরে বাতাসের যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে তা ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে।
বিভিন্ন সংস্থার কম্পিউটার মডেল বলছে, ঘূর্ণিঝড়টির ৭২ ঘণ্টায় নিম্নচাপ পরিণত হতে চলেছে যার বাতাসের আনুমানিক গতি হতে পারে ১০০-১১০ কিলোমিটার। আশঙ্কার কথা, ঘূর্ণিঝড় বা এর আগের পর্যায়গুলো (লঘুচাপ ও নিম্নচাপ) সাগরে যত বেশি সময় ধরে থাকে, তত শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগ পায়। প্রায় সব মডেলই বলছে, ঘূর্ণিঝড়টি ২৫ মে মধ্যরাত থেকে ২৬ মে সন্ধ্যার মধ্যে স্থলভাগে প্রবেশ করবে।
তাই শেষ পর্যন্ত এটি যে সুপার ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হবে না, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তিনি আরও জানান, ২১ মে আন্দামান সাগরে বর্ষা হতে পারে। অপরদিকে যে কোনো ঘূর্ণিঝড় প্রচুর আর্দ্রতা নিয়ে আসে, যা ব্যাপক বৃষ্টি ঝরায়।
তাই দুটি মিলে বেশ বৃষ্টিপাত হতে পারে। ঘূর্ণিঝড় ও ভারী বৃষ্টিপাত সামনে রেখে উপকূল ও নগরে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি। উপকূলের বাঁধগুলো ও আশ্রয়কেন্দ্র সংস্কার, স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত এবং দুর্গত মানুষকে সহায়তা প্রস্তুতি নেওয়ার বেশ সময় আছে। আর ভারী বর্ষণ থেকে যাতে নগরবন্যা না-হয়, সেজন্য শহরের ড্রেন ও খালগুলো জরুরি ভিত্তিতে পরিষ্কার করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে, ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগর দিয়ে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ ধেয়ে আসার পাশাপাশি আরব সাগরে আরও একটি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হতে পারে, যার নাম হবে ‘গুলাব’।
আবহাওয়াবিদ সুজীব কর আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ঝড়টা আমফানের চেয়েও ভয়ানক হবে এবং এটি পাস করতে অনেক বেশি সময় নেবে। ২০০৯ সালে আয়লার সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার। ঘূর্ণিঝড় আমফান বয়ে গিয়েছিল ঘণ্টায় ১৩৩ কিলোমিটারের গতিতে। এবার তাহলে কতটা দাপট দেখাবে ইয়াস? এটাই এখন সবার আশঙ্কা।
আবহাওয়াবিদ রামকৃষ্ণ দত্ত বলেন, আইলা যেমন ক্ষতি করেছিল, তার চেয়ে বেশি গতিসম্পন্ন হবে ইয়াস। যত বেশি জলে থাকবে তত বেশি শক্তি সঞ্চয় করবে, আইলার চেয়ে বেশি প্রভাব থাকবে এর। স্থলভাগে প্রবেশের সময় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ থাকতে পারে ঘণ্টায় ১২০ থেকে ১৫০ কিলোমিটার। অপেক্ষাকৃত কম গতিবেগের বাতাসের কারণে এই ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির সক্ষমতা সম্বন্ধে অনেক মানুষ বিভ্রান্ত হতে পারে। তাই সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাই, ২৬ মে হলো ভরা পূর্ণিমা। ফলে চন্দ্র, সূর্য ও পৃথিবী একই অক্ষে অবস্থান করবে। চন্দ্র ও সূর্যের মিলিত অভিকর্ষে ওই দিন উপকূলীয় এলাকায় প্রাকৃতিক নিয়মেই ২ থেকে ৩ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হবে। সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাবে যার সঙ্গে যুক্ত হবে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ থেকে ১০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস।
আবহাওয়াবিদরা আরও বলছেন, বঙ্গোপসাগরে ঘণিভূত নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপান্তরিত হয়ে ২৫ মের মধ্যে আছড়ে পড়তে পারে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী এলাকায়। এর অভিমুখ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের দিকে। পূর্ব বঙ্গোপসাগরে ঘনীভূত নিম্নচাপ ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হলে প্রাথমিকভাবে ধেয়ে আসতে পারে বাংলাদেশের দিকে। আর এই ঘূর্ণিঝড় যদি উত্তর-পশ্চিম অভিমুখ বদল করে তবে পশ্চিমবঙ্গ ও উড়িষ্যা উপকূলে আঘাত হানতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী,গত বছর ২০ মে সুন্দরবনকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল সুপার সাইক্লোন আম্ফান আর গত দশ বছরে ঘূর্ণিঝড়গুলোর বেশির ভাগই আঘাত হেনেছে মে মাসে। ১৯৬০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৩৬টি ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে, যার মধ্যে ১৫টি এসেছে মে মাসে। আর গত এক যুগে (২০০৮-২০) ৯টি ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে সাতটিই হয়েছে মে মাসে। বাকি দুটির একটি জুলাইয়ে, অন্যটি হয়েছে নভেম্বরে।
হাতে এখনো পাঁচ দিন আছে। জান ও মালের ক্ষতি কমিয়ে আনার জন্য পাঁচ দিন পর্যাপ্ত সময়। বাংলাদেশ সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষের প্রতি অনুরোধ, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধগুলো নিরীক্ষা করে জরুরি মেরামতের পদক্ষেপ নিন। প্রবাদে আছে, রোগ হওয়ার পরে চিকিৎসার চেয়ে রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা নেওয়া অধিক শ্রেয়তর।