১৯৭টি অনুমোদনহীন অবৈধ ইটভাটার কারনে পরিবেশের ক্ষতি
পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী, নওগাঁর মোট এগারোটি উপজেলায় ইটভাটা রয়েছে দু’শো তিনটি। এর মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পেয়েছে মাত্র ছটি। বাকি ১৯৭টি ভাটার কোন ১টিরও পরিবেশগত কোন ছাড়পত্র নেই যার ফলে তারা জেলা প্রশাসন থেকে কোন অনুমোদনও (লাইসেন্স) পায়নি। এরপরও এ সকল অবৈধ ইট ভাটায় থেমে নেই কাজ বরং চলছে ইট পোড়ানো হিড়িক।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গরা বলছেন, জেলার ৯৬ শতাংশ ভাটায় সম্পূর্ন অবৈধভাবে ইট পোড়ানোর কাজ হলেও প্রশাসন কার্যত নীরব ভূমিকা পালন করে। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি পাত্তা না দিয়ে এবং কোন রকম নিয়ম না মেনেই কৃষিজমি ও আবাসিক এলাকার মধ্যে বা খুব নিকটে গড়ে ওঠা এসব ভাটার কারণে পরিবেশ মারাত্বক দূষিত হচ্ছে। এতে একদিক দিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি, পরিবেশ বাড়ছে, অপর দিকে ব্যাহত হচ্ছে কৃষি এবং ফলজ উৎপাদন ।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০১০ ও ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৩ অনুযায়ী নির্দৃষ্ট এলাকা যেমন- বসতি এলাকা, পাহাড়, বন ও জলাভূমির এক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো প্রকার ইটভাটা নির্মাণ করা যাবে না। কৃষিজমিতেও বা এর আশেপাশে কোনো ইটভাটা বৈধ হিসেবে গণ্য হবে না।
বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (বাপা)স্থানীয় জেলা শাখার সহসভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, আইনের তোয়াক্কা না করে আবাসিক এলাকা ও কৃষিজমিতে বা এর খুব কাছাকাছি এলাকায় গড়ে উঠছে ইটভাটা। এসব ভাটার ধোঁয়ায় ফসল ও ফলজ গাছের ক্ষতি হচ্ছে। মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও প্রকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। কিন্তু এ ব্যাপারে প্রশাসন কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না, যা খুবই হতাশাজনক।
সদর উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম বলেন যে, ইট ভাটার মালিকেরা সবাই লাইসেন্স নবায়ন করতে চান। কিন্তু বর্তমান ইটভাটা প্রস্তুত আইনের শর্ত পূরণ না হওয়ায় আইনি জটিলতা তৈরি হয়েছে তবে অনেক ইটভাটার উন্নত প্রযুক্তির চিমনি থাকা সত্ত্বেও কৃষিজমি কিংবা বসতি এলাকায় ইটভাটা থাকায় পরিবেশ ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে না।
জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর নওগাঁ জেলা কার্যালয় থেকে বিশ্বস্ত্ব সূত্রে জানা গেছে, পরিবেশগত ছাড়পত্র না থাকায় ২০১৮ সাল থেকে ১৯৭টি ইটভাটার মালিক তাঁদের ভাটার লাইসেন্স নিবন্ধন বা নবায়ন করতে পারেননি। ফলে বৈধ ইটভাটা রয়েছে মাত্র ছয়টি। জেলায় সবচেয়ে বেশি ইটভাটা আছে মান্দা উপজেলায়।
এই উপজেলার ৩৮টি ভাটার ১টিরও পরিবেশগত কোন ছাড়পত্র নেই। এরপরই বেশি ইটভাটা রয়েছে সদর উপজেলায়, ৩৫টি। এর মধ্যে মাত্র ৩টির পরিবেশগত ছাড়পত্র রয়েছে। আত্রাই উপজেলায় ১৬টি ইটভাটার মধ্যে পরিবেশগত ছাড়পত্র রয়েছে ২টির। নিয়ামতপুর উপজেলায় ৬টি ইটভাটার মধ্যে ১টির পরিবেশগত ছাড়পত্র রয়েছে।
এ ছাড়া বদলগাছি উপজেলায় ছাব্বিশটি, মহাদেবপুরে বিশটি, পত্নীতলায় সতেরোটি, ধামইরহাটে একুশটি, রাণীনগরে বারটি, পোরশায় দশটি ও সাপাহারে দুটি ইটভাটা রয়েছে তবে এসব উপজেলার কোনো ইটভাটারই পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই।
এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এসব গ্রামের বসতি এলাকার পাশে ও ফসলি জমির মাঠে চারদিকে সবসময় ধোঁয়ার কুণ্ডলী। ইটভাটার উঁচু চিমনির কালো বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে এলাকার চারদিকে। পাহাড়পুর গ্রামে ১২০-১৩০টি পরিবারের বসবাস এবং ওই গ্রামের পশ্চিমে বসতি এলাকার প্রায় ১৫০ মিটার দূরেই মেসার্স বিবিসি ব্রিকস নামের একটি ইটভাটার পাশাপাশি দু’টি চিমনি রয়েছে।
নাম প্রকশে অনিচ্ছুক ভাটার এক শ্রমিক বলেন, প্রতিদিন তাঁদের ভাটার দুটি চিমনিতে চার টনের বেশী কয়লা পোড়ানো হয় আর এই কয়লা দেওয়ার সময় জিগজ্যাগ থেকেও প্রথম ১-৫ মিনিট পর্যন্ত কালো ধোঁয়া বের হবে আবার আধা ঘণ্টা পর নতুন করে কয়লা দেওয়া হলে আবার ৫ মিনিট পর্যন্ত কালো ধোঁয়া বের হয়।
কৃষক আবদুস সালাম বলেন, এবার শীত মৌসুমে ২ বিঘা জমিতে বাঁধাকপি ও ফুলকপির চাষ করেছিলেন। কিন্তু দু’টি ইটভাটার বিষাক্ত কলোধোঁয়ার কারণে অনেক গাছ মরে যায় পাশাপাশি এই মাঠে ধানের ফলনও ভালো হয় না। বসতবাড়ির আশপাশে লাগানো ফলের গাছগুলোতে ফলন একেবারেই আসে না।
মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুর ইউনিয়নের চৌমাশিয়া গ্রামের বাসিন্দা জিয়াউল, মনসুর আহমেদ, সামসুদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন বলেন, চৌমাশিয়া গ্রামের ফসলি দুটি কৃষিজমির মাঠে বারোটি ইটভাটা গড়ে উঠেছে আর এসব ইটভাটার কালো ধোঁয়ার কারণে ঠিকমতো নিশ্বাস নেওয়া যায় না।
পরিবেশ অধিদপ্তর নওগাঁ কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মকবুল হোসেন বলেন, ‘অবৈধ ভাটাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার জন্য জেলা প্রশাসনে একাধিকবার চিঠি দিয়েছি তবে ম্যাজিস্ট্রেট না পাওয়ায় নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা যাচ্ছে না।’
এ বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক উত্তম কুমার রায় বলেন, গত বছর থেকে করোনার সংক্রমণের কারণে, অন্যদিকে কাজের চাপের কারণে ইটভাটায় অভিযান চালানোর জন্য নিয়মিত ম্যাজিস্ট্রেট দেওয়া সম্ভব হয়নি তবে আগামী দিনে অবৈধ ভাটাবিরোধী অভিযান নিয়মিত চালানো হবে।