হুমকির মুখে বিশ্বের বৃহত্তম স্তন্যপায়ী অভিবাসন
আল জাজিরা থেকে নেয়া
জাম্বিয়ার মধ্যাঞ্চলীয় প্রদেশের একটি অত্যান্ত জনমানবহীন এলাকায় সন্ধ্যার লাল সূর্য ডোবার অপেক্ষায় রয়েছে। ঠিক এমন সময় হঠাৎ খুব জোরে পাখা ঝাপটানোর শব্দ শোনা যায় এবং আকাশ গাড় মেঘের মত কালো হয়ে যায়। সন্ধ্যার আকাশ তখন দখলে নিয়েছে প্রায় ১ কোটি বা তারও অনেক বেশী ময়লা হলদেটে রঙের স্ট্র-কলর্ড ফ্রুট ব্যাট (fruit bat), আর স্থানীয়ভাবে বাদুড় বা কলাবাদুড় নামে পরিচিত।
ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউট ফর অরনিথলজি’র বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বে স্তন্যপায়ীদের সবচেয়ে বড় অভিবাসনের এই কলোনি আফ্রিকার ফ্রুট বাদুড়ের সমন্বয়ে গঠিত।
প্রতি নভেম্বরে,কাসানকা জাতীয় উদ্যানের মুসোলা নদীর তীরে ঘন জলাভূমিতে দিনের বেলায় বাদুড়গুলো পৌঁছে যায় এবং পরের কয়েক মাস তাদের অর্ধ হেক্টরেরও কম আকারের একটি ছোট্ট অঞ্চলে ঝুলতে থাকে। প্রতিটি গাছ ১০ টন পর্যন্ত বাদুড় সহ্য করতে পারে।
এই ২ মাসের মধ্যে, জাম্বিয়ার এই ক্ষুদ্র অংশটি স্তন্যপায়ী প্রাণীর ঘন ঘনত্বকে স্বাগত জানায়। এই পার্কে ৪৭০টিরও বেশি পাখির প্রজাতি এবং ১০০ স্তন্যপায়ী প্রাণীর বাস করে।
সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে তারা নেমে আকাশকে ঢেকে দিয়ে বন্য বেরি এবং ফলমূল খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে বাদুড়গুলো। রাতের বেলা খাওয়া ফলের ওজনের ব্যাটের নিজেই ওজনের দ্বিগুণ। প্রায় ৫০ কিলোমিটার এলাকা ঘুরে ভোরের দিকে জলাভূমিতে নিজেদের বাসস্থানে ফিরে আসে তারা।
এই ঘটনা বছরে কেবল একবারই ঘটে, সেটা অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে। তবে গবেষকরা এখনও জানেন না যে এই বাদুড়গুলি বছরের বাকি অংশটি কোথায় ব্যয় করে তবে সন্দেহ হয় যে তারা আফ্রিকা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আফ্রিকার বন পুনরুদ্ধারের জন্য হুমকির মুখে থাকা বাদুড়গুলো ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
ময়লা হলদেটে রঙের বাদুড় কাঠের বনটি আফ্রিকা উদ্যানপালক হিসেবে পরিচিত এবং দেশীয় ফলের গাছের পুনর্জন্মের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অভিবাসী প্রজাতি হিসেবে তারা হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়। এই ব্যাটগুলির কয়েকটিতে ট্র্যাকিংয়ের ডিভাইস সংযুক্ত থাকা গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন যে তারা মাসে ৯৬৫ কিলোমিটারেরও বেশি পথ চলে।
তবে তাদের অভিবাসনের রুট সম্পর্কে এখনও খুব বেশি কিছু জানা যায়নি। এই দূরত্বটি আরও স্পষ্টভাবে কল্পনা করার জন্য, আপনি মানসিকভাবে ওয়াশিংটন থেকে ডেট্রয়েট পর্যন্ত একটি সরল রেখা আঁকতে পারেন। আবার কেন তারা এত বিপুল পরিমাণে কাসানকায় জড়ো হয় তাও অজানা।
তবে প্রাচীন অঞ্চল এবং জাতীয় উদ্যানগুলো হুমকির মুখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে তারা আবাসস্থলও। পার্ক পরিচালনা করা কাসানকা ট্রাস্টের কমিউনিটি আউটরিচ ম্যানেজার জেমস এমওয়ানজা বলেছেন, বাণিজ্যিক কৃষি প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য প্রধান হুমকি, বাদুড় ও পার্কের আশেপাশের কমিউনিটি এই সম্পদের ওপরই নির্ভরশীল।
তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন উন্নয়ন ঠেকাতে একটি বড় বাফার জোন তৈরি করেছি। মানুষ ও প্রাণীর সহাবস্থান নিশ্চিত করতে এই বাফার জোন গুরুত্বপূর্ণ। এই বাফার জোনের মধ্যে ‘কোনও ফার্ম, বসতি বা কর্মকাণ্ড’ ঘটার কথা নয়।
তবে বনভূমি রক্ষায় শুধু এটাই অন্য আরও পদক্ষেপও নেয়া হচ্ছে বলে জানান এমওয়ানজা। এরই অংশ হিসেবে স্থানীয় কমিউনিটিকে পার্কের আশপাশের ষাট হাজার হেক্টর এলাকার বৈধ মালিক করতে কাজ করে যাচ্ছে কাসানকা ট্রাস্টটি।
কমিউনিটি ফরেস্ট গার্ডের একজন স্বেচ্ছাসেবক ও কৃষক চার্চিল মুসুনগওয়া তার চারপাশে বন ধ্বংস হতে দেখেছেন। কাসানকা ট্রাস্ট তার কমিউনিটিকে পার্কের আশপাশের জমির বৈধ মালিকানা দিতে কাজ করে যাচ্ছে।
চার্চিল মুসুনগওয়া আরো বলেন, যদি আমাদের কোনও গাছ না থাকে, বন না থাকে তবে তা কেবল আমরা মানুষরাই নই; পাখি, প্রাণী- আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবো। ট্রাস্টের পরিবেশবাদী শিক্ষা অফিসার নিয়াম্বে কালালুকা বলেছেন, আমরা কমিউনিটি বন এবং অন্যান্য পদক্ষেপের মাধ্যমে বন উজাড় ঠেকাতে চাচ্ছি। কাসানকা ন্যাশনাল পার্কের আশেপাশের অধিকাংশ মানুষ বন থেকেই তাদের জীবিকা নির্বাহ করে।
আসলে জাম্বিয়া জুড়েই বন উজাড় একটি বড় ইস্যু এবং একারনে প্রধানত এই সংকটটি তৈরী হয়েছে। রাজধানী লুসাকার আন্তর্জাতিক বন গবেষণা কেন্দ্র (সিআইএফওআর) বলছে, জ্বালানি কাঠ এবং কাঠ কয়লা এবং কৃষিকাজের জন্য দেশটিতে প্রতি বছর ‘উদ্বেগজনকভাবে’ দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার থেকে তিন লাখ হেক্টর বন উজাড় করা হচ্ছে।
জাম্বিয়ার অঞ্চলটি মূলত জলবিদ্যুৎ শক্তির উপর নির্ভরশীল। তবে সাম্প্রতিক খরায় জ্বালানির চাহিদা বাড়িয়েছে। সেক্ষেত্রে দেশের প্রায় নব্বই শতাংশ মানুষ জ্বালানি কাঠের উপর নির্ভর করে। সিআইএফওআর’র ডেভিয়ন গুম্বো বলেছেন, কিছু অঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং কৃষিজমির অতিরিক্ত ব্যবহার এবং নতুন বনাঞ্চলের খোঁজে কাসানকার মতো বনাঞ্চলে অভিবাসনের ফলে এটি প্রাকৃতিক একটি পরিণতি।
তিনি বলেন, বনভূমি উজাড়ের প্রবণতা ঊর্ধ্বমুখী। এটি কেবলমাত্র বন উজাড়ই নয়, অবক্ষয় ও বনের গুণগত ক্ষতির সঙ্গে সম্পর্কিত। এসব উপাদানের ক্ষতির কারণে জীববৈচিত্র্যেরও প্রভাব পড়ছে। কৃষিকাজ বৃদ্ধি এবং শস্য উৎপাদনে বন পরিষ্কারই বনভূমি উজাড়ের মূল কারণ বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি।