হারানোর পথে পৃথিবীর অতি মূল্যবান দশটি প্রাকৃতিক সম্পদ
অ্যামাজন থেকে ডেড সি পর্যন্ত এমন কিছু প্রাকৃতিক সম্পদ ও শপ্ত আশ্চার্য আছে যেগুলো এখন অতিরিক্ত পর্যটন, জলবায়ু পরিবর্তন বা দূষনের কারণে হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় পৌছেচে ৷ এমন দশটি প্রাকৃতিক সম্পদের বিবরণ তুলে ধরা হলো।
বিপর্যয়ে ধুঁকছে পৃথিবীর ‘ফুসফুস’ নামে খ্যাত অ্যামাজন রেইনফরেস্ট
আমাজন রেইনফরেস্ট বা চিরহরিৎ বন প্রায় ৭ হাজার ৯শত বর্গমাইল এলাকা জুড়ে যা কিনা গোটা লন্ডন শহরের চেয়েও অন্তত ৫ গুণ বড়। দক্ষিণ অ্যামেরিকার ৯টি দেশে ছড়িয়ে থাকা এই গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রেইনফরেস্টে রয়েছে অনেক রকমের গাছপালা এবং প্রাণী৷ পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি কার্বন শুষে নিতে সক্ষম বনাঞ্চলও এটি।
ব্রাজিলের আমাজন নদী অববাহিকার আমাজন রেইনফরেস্ট গত এক দশকে সবচেয়ে বেশি হারে উজাড় হয়েছে। অবৈধভাবে গাছ কাটাকেই এর অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেছেন ব্রাজিলের পরিবেশ মন্ত্রী এডসন ডুয়ার্ট। গত ১২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গাছ ধ্বংস হয়েছে চলতি ২০২০ সালে যা হাইতি’র সমপরিমাণ বনাঞ্চল যার আয়তন ২৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি৷ প্রাণী হত্যার হারও বাড়ছে৷ কোনো কোনো জায়গায় বৃষ্টিপাত এক চতুর্থাংশ কমেছে৷
![Coral and fish at the Great Barrier Reef off coast of Australia Coral and fish at the Great Barrier Reef off coast of Australia](https://static.dw.com/image/53601230_303.jpg)
দ্য গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ : পৃথিবীর বিস্ময় আর মাত্র ৮০ বছর
অস্ট্রেলিয়ার উত্তর-পূর্ব উপকূলের কোরাল সাগরের সর্ববৃহৎ প্রবাল প্রাচীর দ্য গ্রেট ব্যারিয়ার রিফে রয়েছে ২ হাজার ৯০০টির বেশি প্রবাল প্রাচীর, ৪০০ রকমের প্রবাল, ৫০০ প্রজাতির মাছ এবং সামুদ্রিক কচ্ছপসহ ৪০০০ ধরনের মলাস্ক এবং ৯০০টি দ্বীপের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা৷ লাখ লাখ বছর ধরে লক্ষ লক্ষ জীবন্ত প্রাণী একত্র হয়ে বিশাল প্রবাল প্রাচীর গঠিত হয়েছে তবে কীভাবে এটি গড়ে উঠেছে সে রহস্য আজো রহস্য।
কিন্তু পানির তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় প্রবালদের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য শেওলা অনেক বেশি হারে ছড়িয়ে পড়ছে৷ অর্ধেক রিফ ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে৷
পরিবেশবিদ রোয়ান জ্যাকবসেন ২০১৬ সালেই এটির মৃত্যু হয়েছে বলে ঘোষণা করেছেন তবে অনেক পরিবেশবিদ এটি আগের মতোই রয়েছে বলে জানিয়েছেন। বিশ্বের তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হারে বাড়তে থাকলে ২১০০ সালের মধ্যে বিশ্বের সবচয়ে বড় এই প্রবালের মৃত্যু হতে পারে৷
ডারউইনের বিপন্ন স্বর্গ
দক্ষিণ অ্যামেরিকার পশ্চিম উপকূল থেকে ১০০০ কিলোমিটার দূরে এই বিস্ময়কর ইকুয়েডরের গালপাগোস দ্বীপপুঞ্জ। ১২০টি দ্বীপের সমন্বয়ে এটি গঠিত।
বহু বৈচিত্রপূর্ণ প্রাণী, গালাপাগোস কচ্ছপ, গাছপালা ও ভলকানিক আর্কিপেলাগোর কারণে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে এটি৷ এখানকার কিছু বিরল প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদের বিবর্তনই ডারউইনকে প্রেরণা জুগিয়েছিল আর ইসলা সান্তা ক্রুজের চার্লস ডারউইন গবেষণা কেন্দ্র৷
পর্যটকদের আনাগোনা, দূষণ এবং মাত্রাতিরিক্ত মাছ শিকারের কারণে এই প্রাকৃতিক ঐতিহ্যবাহী ভূস্বর্গের ভবিষ্যৎও হুমকির মুখে৷
![Hundreds of tourists line up to reach peak of Mount Everest Hundreds of tourists line up to reach peak of Mount Everest](https://static.dw.com/image/48870713_303.jpg)
হিমালয় : হিমবাহ গলছে, আসছে ভয়াবহ বন্যা-খরা এবং গড়ে উঠছে আবর্জনার পাহাড়।
বৈশ্বিক তাপমাত্রা যেভাবে বাড়ছে, তাতে হিমালয় ও হিন্দুকুশ পর্বতমালার হিমবাহ আশঙ্কাজনক হারে গলছে৷ এই গতি চলতে থাকলে ২১০০ সাল নাগাদ এই হিমবাহের অর্ধেক গলে নিঃশেষ হবে। এর ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্ভরশীল ১শত ৬৫ কোটি মানুষের জীবন নেমে আসবে ভয়াবহ বিপর্যয়।
অপরদিকে হিমালয় ধীরে ধীরে ঢাকা পড়ছে আবর্জনার স্তূপে৷ গত চার দশকে দশ হাজারেরও বেশি বার হিমালয়ের চূড়ায় উঠেছে মানুষ৷ কতজন পর্বতারোহী সফল হয়েছেন, কতজন ব্যর্থ হয়ে ফিরেছেন বা কতজনের জীবনাবসান হয়েছে বন্ধুর পথে, তার প্রকৃত সংখ্যা জানা যায়নি৷ তবে সবাই মিলে হিমালয়ে যে পরিমাণ আবর্জনা ফেলেছেন এবং আবর্জনা যে হারে বাড়ছে, তাতে হিমালয়ের ভবিষ্যৎ নিয়েও জাগছে শঙ্কা৷
বৈশ্বিক তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে বাড়ে , তাহলে হিমবাহের অর্ধেক ২১০০ সালের মধ্যে গলে যাবে যা থামানো না গেলে, এই অঞ্চলে বর্ষা ঋতুতে নাটকীয় পরিবর্তন আসবে। এই সুবিশাল বরফক্ষেত্র এভাবে গলতে থাকলে ১শত বছরের কম সময়ের মধ্যেই এর শিলাময় পর্বত বরফ গলে নিঃশেষ হয়ে অবমুক্ত হয়ে পড়তে পারে।
![Joshua Trees in California Joshua Trees in California](https://static.dw.com/image/43434238_303.jpg)
জোসুয়া ট্রি ন্যাশনাল পার্ক : জোসুয়া গাছই শেষ হওয়ার পথে
যিহোশূয় বৃক্ষ বা জোসুয়া ট্রি এর বাঁকানো অঙ্গ এবং ভাস্কর্যের ফর্মগুলি যিহোশূয় বৃক্ষের আড়াআড়ি একটি অপূর্ব গুণ যুক্ত করে। ক্যালিফোর্নিয়ার জোসুয়া ট্রি ন্যাশনাল পার্কের জোসুয়া গাছ কতদিন থাকবে কে জানে!
এখানে বিস্ময়কর আবহাওয়া চরমতা দেখা যায়। যেমন – শীতকালে বরফ এবং জমা ঠান্ডা আবহাওয়া আবার গ্রীষ্মে প্রচন্ড গরম আবহাওয়া যা নিয়মিতভাবে ১০০ ডিগ্রির উপরে থাকে।
উষ্ণায়ন রোধ করা যাচ্ছে না, খরার কারণে জোসুয়ার চারা মরে যাচ্ছে বড় হওয়ার আগেই, পরাগায়নও পড়ছে প্রতিকুলতার মুখে৷ জোসুয়া ট্রি ন্যাশনাল পার্কে জোসুয়া গাছ বেশিদিন থাকবে কী করে?
![Elephants in front of Kilimanjaro Elephants in front of Kilimanjaro](https://static.dw.com/image/18854350_303.jpg)
কিলিমানজারো : বরফ না থাকলে কী হবে!
আফ্রিকার সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কিলিমানজারোর ভবিষ্যৎকেও শঙ্কায় ঘিরে ফেলছে উষ্ণায়ন৷ কিলিমানজারো বিশ্বের সপ্তশৃঙ্গের একটি।
পর্বতশৃঙ্গটিতে তিনটি আগ্নেয়শৃঙ্গ রয়েছে যেগুলো – কিবো, মাওয়েনজি, শিরা এবং সর্বোচ্চ শৃঙ্গটি হচ্ছে কিবো যার উচ্চত্ সমুদ্রপৃষ্ণ থেকে ৫৮৯৫ মিটার উঁচুতে গিয়ে ঠেকেছে৷ মাওয়েনজি ও শিরা অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে আর কিবো সুপ্ত অবস্থায় আছে, যেকোনো সময় ফেটে যেতে পারে ।
শিখর থেকে বরফ গলে পড়ছে দ্রুত৷ গবেষকরা বলছেন, ১৯১২ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৮৫ ভাগ বরফই হারিয়েছে কিবোর বরফাচ্ছাদিত জ্বালামুখ থেকে ৷ তিন লাখ ৬০ হাজার বছর আগে সর্বশেষ বড় অগ্ন্যুৎপাত হয়েছে এটি থেকে আর ২০০ বছর আগে এটি সক্রিয় ছিল বলে ধারণা করা হয়।
মাচু পিচু : মানব সৃষ্ট এক অপরুপ বিস্ময়ের সৃষ্টি যা আজ পদদলিত সভ্যতা
পেরুর উরুবাম্বা নামক এক উপত্যকার ওপরে পর্বত চূড়ায় মানবসৃষ্ট কিন্তু অসাধারণ সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি হল পেরুর মাচু পিচু শহর যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২৪০০ মিটার বা, ৭,৮৭৫ ফিট উপরে অবস্থিত। ইতিহাস ও গবেষনা করে প্রায় সকল পুরাতত্ববিদই বিশ্বাস করেন যে, মাচু পিচুকে পাচাকুতিক (১৪৩৮-১৪৭২) নামক ইনকা রাজার শাসন আমলে ১৪৫০ সালে গড়ে তোলা হয়েছিল।
গড়ে তোলার ১০০ বছরের মাঝেই এ শহরের প্রায় সকল মানুষ গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ায় কার্যত পরিত্যাক্ত হয়ে যায়। অনেকের মতে মাচুপিচু ছিল ধর্মীয়ভাবে পবিত্র এক জায়গা আবার অনেকেই আছেন যারা মনে করেন এটি আসলে ইনকা রাজাদের নির্মিত ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব অপরাধীদের জন্যে বানানো এক জেলখানা ছিল।
ইনকাদের রাজধানী কোস্কো থেকে মাত্র ৮০ কি.মি. দূরেই অবস্থিত ছিল এই মাচুপিচু শহরটি। ইনকাদের এই শহর গত ৪০০ বছরে অসংখ্য ভূমিকম্প সহ্য করেও বহাল তবিয়তে টিকে রয়েছে। ২০০০ সালের মাঝেই প্রায় ৪ লাখ পর্যটক মাচু পিচু ভ্রমণ করে ফেলেছিল। বর্তমানে এটি পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি
প্রতি বছর অন্তত ১৫ লাখ পর্যটকের পা পড়ে পেরুর এই বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পাওয়া ইনকা নিদর্শনে৷ এত মানুষের হাঁটাচলায় যে কম্পন তৈরি হয় তাতে প্রাচীন এই কাঠামো ক্রমশ নড়বড়ে হচ্ছে৷
মালদ্বীপ : তলিয়ে যাচ্ছে নীল সাগরে
বিমানে চড়ে মালদ্বীপে যাওয়ার কথা ভাবছেন? গেলে দ্বীপদেশটি দেখে মুগ্ধ হবেন নিশ্চয়ই, সঙ্গে দেশটিকে একটু ডুবিয়েও আসবেন৷ দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটিতে শুধু আকাশপথেই যাওয়া যায় বলে ঘন ঘন বিমান চলাচলের বিরূপ প্রভাব পড়ছে জলবায়ুতে৷
বিশ্বের সবচেয়ে নিচু দেশটির উচ্চতা মাত্র ২ দশমির ৩ মিটার এবং গড় উচ্চতা ১ দশমিক ৫ মিটার যা উষ্ণায়নের কারণে প্রতিবছর ৩.৭ সেন্টিমিটার করে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা।
পরিবেশবিদদের আশঙ্কা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় গোটা দেশটার সাগরে তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও বাড়ছে যার ফলে এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ দ্বীপরাষ্ট্রটি সমুদ্রে বিলীন হয়ে যেতে পারে ৷
লেক নিকারাগুয়া : খালে আসছে ‘কুমির’
প্রস্তাবিত নিকারাগুয়া খাল হয়ে গেলে ক্যারিবীয় সাগরের সঙ্গে যুক্ত হবে প্রশান্ত মহাসাগর৷ মধ্য অ্যামেরিকার সবচেয়ে বড় হ্রদটিতে তখন ডিঙি নৌকা উধাও হয়ে যেতে পারে, শুরু হতে পারে বড় বড় অনেক কন্টেইনার জাহাজের আনাগোনা৷
পরিবেশবাদীরা শঙ্কিত৷ অনেক হাঙর আর করাতি মাছের আবাস, স্থানীয়দের পানীয় জলের আধার এই হ্রদের ইকোসিস্টেমই তো তাহলে ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাবে!
![A woman floats in the Dead Sea A woman floats in the Dead Sea](https://static.dw.com/image/36413307_303.jpg)
মধ্যপ্রাচ্যের ‘মৃত সাগর’-সঙ্কুচিত হয়ে সত্যিই মারা যাচ্ছে
বিশ্বের সবচেয়ে নীচু জলাধার ডেড সি ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে৷ যে জর্ডান নদী থেকে এখানে পানি আসে, সেই নদীর থেকে পানীয় জল আহরণ করছে ইসরায়েল ও জর্ডান৷ তার প্রভাব পড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪২০ মিটার নীচের ডেড সি-তে৷
প্রতি বছর গড়ে এক মিটারে র মতো নেমে যাচ্ছে ডেড সি৷ গতবছরও এখানে পর্যটকদের জন্য থাকার জায়গা, দোকানপাট সহ আরো অনেক ধরনের সুযোগ সুবিধা থাকলেও পুরো এলাকা জুড়ে তৈরি হচ্ছে সিংকহোল যার কারণে প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি হওয়া মাটির গর্তে দেবে যাচ্ছে পুরো এলাকা।
কয়েক হাজার চোরাবালির মত সিংকহোলে দেবে গেছে প্রচুর স্থাপনা খুব অল্প সময়ের ভিতরে।