বিশ্বের বেশীর ভাগ মানুষেরই হাত ধোঁয়ার সুযোগ কম – বিশ্ব ব্যাংক
সাবান দ্বারা ও পানি ব্যবহার করে তোমার হাত ধোও – কথাটা খুবই সহজ, কিন্তু ব্যক্তি পর্যায়ে ও জনস্বাস্থ্যের উপর এর প্রভাব অত্যধিক। ইহা ডায়েরিয়া ও শ্বাস যন্ত্রের প্রদাহ জনিত রোগ যেমন কোবিদ -১৯ সংক্রামন প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর ও সুলভ প্রদ্ধতি।
ইউনিসেফ (UNICEF) এর হিসাব অনুযায়ী সাবান দিয়ে হাত ধোয়া ৪০% ডায়েরিয়া রোগ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে। সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রতিলোধে অত্যন্ত কার্যকর ব্যবস্থা হিসাবে বর্তমান বিশ্বে করোনা ভাইরাসসহ অন্যান্য ভাইরাস জনিত জীবানুর সংক্রমণ ঠেকাতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বিশ্ববাসীকে সাবান ও পানি দ্বারা ভাল করে হাত ধোঁয়ার জন্য পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে।
হাত ধোঁয়া সবচেয়ে কার্যকর স্থাস্থ্যবিধি (hygiene) সম্মত হওয়ায় জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য মাত্রা (Sustainable Development Goal- SDG) এর ৬ নং লক্ষ্যমাত্রা (SDG 6 -Clean Water and Sanitation) এর আওতাভুক্ত এবং তৎদ্বারা মনিটরিং করা হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ (WHO/UNICEF) বাড়িতে সাবান ও পানি দ্বারা হাত ধোঁয়াকে প্রত্যেক মানুষেরই মৌলিক অধিকার বলে সজ্ঞায়িত করেছে এবং বিশ্বের কত সংখ্যক লোক, বিশেষত দরিদ্র ও নিন্ম মধ্য আয়ের দেশগুলোর ক্ষেত্রে এ মৌলিক অধিকার পালন করছে ও পালন করতে সুযোগ পাচ্ছে তার হিসাব করছে ও মনিটরিং করছে। এক্ষেত্রে বিশ্ববাসী স্থাস্থ্যবিধি (hygiene) সম্মত হাত ধোঁয়ায় কি রকম চ্যালেঞ্জ এর মোকাবেলা করতে হচ্ছে তা নিন্মে প্রদত্ত হল।
নিন্মে বিশ্ব মানচিত্রে স্থাস্থ্যবিধি (hygiene) সম্মত হাত ধোঁযার হার দেখানো হল, যে সকল দেশের স্থাস্থ্যবিধি (hygiene) সম্মত হাত না ধোঁয়ার হার যত বেশী সে সকল দেশের রংয়ের ঘনত্ব তত বেশী দেখানো হয়েছে। দেখা যাচ্ছে যে, সাহারা মরুভূমির নিকটবর্তী দেশমসমূহের মধ্যে এ হার সবচেয়ে বেশী অর্থাৎ কোন কোন দেশের প্রায় ১০০% জনগনই স্বাস্থ্য সম্মতভাবে হাত ধোঁয়ার সুযোগ পাচ্ছে না বা হাত ধুচ্ছে না।
আর এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের মাত্র ৩৪.৮% এবং আফগানিস্থানের ৩৭.৭% জনসংখ্যা স্থাস্থ্যবিধি (hygiene) সম্মতভাবে হাত ধোঁয়ার সুযোগ পাচ্ছে বা ধৌত করছে। অথচ এ দুটি দেশ মুসলিম প্রধান দেশ এবং ধর্ম পালন ক্রিয়া অর্থাৎ দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার জন্য হলেও পবিত্র হওয়ার জন্য স্থাস্থ্যবিধি (hygiene) সম্মতভাবে হাত ধোঁয়া পালন করার নিয়ম রয়েছে।
বিভিন্ন দেশে হাত ধোঁয়ার সুযোগ সুবিধাসমূহ
২০১৭ সালের গুচ্ছ, জনসংখ্যা গণনা ও জনস্বাস্থ্য (Cluster Surveys and Demographic and Health) সার্ভে হতে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে বিশ্বের ৭৭ টি দেশে বাড়িতে বা বসবাসের ঘরে সাবান ও পানি দ্বারা হাত ধোঁয়া সুযোগ রয়েছে। ৪২ টি দেশের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যার বাড়িতে বা ঘরে সাবান ও পানি দ্বারা হাত ধোঁয়ার কোন ব্যবস্থাই নাই। এ সকল দেশের মধ্যে আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশ গুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান রয়েছে।
এ সকল দেশের মধ্যে লিবিয়া, লিসিুথো, কঙ্গো ও রুয়ান্ডার মত সাব – সাহারা অঞ্চলের দেশগুলোর মাত্র ৫% জনসংখ্যা স্থাস্থ্যবিধি (hygiene) সম্মতভাবে হাত ধোঁয়ার নিয়ম পালন করে। হাইতি, ভেনুতু, বলিভিয়া, তিমুরের মত সাব – সাহারার বাহিরে অবস্থিত আফ্রিকার দেশগুলোর মাত্র ৩০% জনসংখ্যা তাদের বাসস্থানে স্বাস্থ্য সমম্ত ভাবে হাত ধোঁয়ার সুযোগ পাচ্ছে। বাংলাদেশের মাত্র ৩৪.২%।
যে সকল দেশে স্থাস্থ্যবিধি (hygiene) সম্মতভাবে হাত ধোঁয়া পালন করছে না – তা শুধু এ জন্য নয় যে তারা হাত ধোঁয়ার জন্য পানি ও সাবান পাচ্ছেনা – আসলে অভ্যাসগতভাবেই তারা তা পালন করছে না। ইউনেসেফ খুজে বের করেছে যে, অনেক নিন্ম আয়ের দেশ রয়েছে তাদের হাত ধোঁয়ার জন্য পানি ও সাবান থাকা স্বত্বেও তারা স্বাস্থ্য সমম্ত ভাবে হাত ধৌত করছে না – আসলে এর জন্য অভ্যাস পরিবর্তনের প্রয়োজন।
নিন্মে বিশ্বের যে সকল দেশে ৫০% এরও কম জনসংখার সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার সুবিধা বিদ্যমান নাই, এমন ৪২ টি দেশের জনগনের সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার সুবিধার চিত্র বার চার্টে উপস্থাপন করা হল, যেখানে দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশের মাত্র ৩৪.২% জনসংখ্যার জন্য সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোঁয়ার সুবিধা বিদ্যমান রয়েছে।

হাত ধোঁয়ার আসল সময়সমূহ
সাধারনত খাওয়ার পূর্বে ও পরে হাত ধোঁয়ার প্রয়োজন এবং হাঁচি, কাঁশি দেয়ার পর এবংং কফ ফেলার পর ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস মুক্ত করার জন্য হাত ধোঁয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পায়খানা ব্যবহার করার পর হাত ধোঁয়া অপনরহার্য। কারন, মানুষের মল বিভিন্ন জীবানু যেমন সেলমোনেল্লা (Salmonellae), নরোভাইরাস (Norovirus) এর মত ব্যকটেরিয়া ও ভাইরাসের প্রধান উৎস। উল্লেখ্য Salmonellae এক প্রকার ব্যাকটেরিয়া এবং ইহা খাদ্যনালীর প্রদাহ সৃষ্টি করে।
আর Norovirus এক প্রকার সংক্রামনক ভাইরাস যা মানুষের বুমি ও ডাইরিয়ার জন্য দায়ী। কিন্তু বিশ্বের অনেকের আর্থিক অবস্থা এমন যে তাদের পক্ষে এখনও স্বাস্থ্য সম্মত হাত ধোঁয়ায় সক্ষমতা নাই।
বিশ্বের ৭ টি দেশ রুয়ান্ডা, এজওয়াসিনি, সেনেগাল, বলিভিয়া, টিমুর, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং নেপালের জনগোষ্ঠীর অর্ধেকেরও অধিক পরিবারের বাসায় ন্যূনতম পয় সুবিধা বা টয়লেট রয়েছে, কিন্তু তারও অর্ধেকের কম সংখ্যক পরিবারের বাড়িতে সাবান ও পানি দ্বারা হাত ধোঁয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
উদাহরন স্বরূপ রুয়ান্ডার কথাই বলা যাক, ৬৭% অধিবাসীর বাড়িতে ন্যূনতম পয় সুবিধা বা টয়লেট রয়েছে, কিন্তু রুয়ান্ডায় সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোঁয়ার হার মাত্র ৫%।
নিন্মে বিশ্বের যে সকল দেশে ৫০% এরও কম জনগনের বাসস্থানে পয় সুবিধা বা পায়খানার সুবিধা বিদ্যমান নাই, এমন ৪২ টি দেশের সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার সুবিধা বিদ্যমান এবং হাত দোয়ার হার তুলনামূলক হার বার চার্টে উপস্থাপন করা হল, যেখানে দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশের ৪৮.২% জনসংখার বাসস্থানে পয় সুবিধা বা পায়খানা বিদ্যমান রয়েছে এবং তার বিপরীতে ৩৪.২% জনসংখ্যার জন্য সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোঁয়ার সুবিধা বিদ্যমান রয়েছে।

বিশ্বের কোন জনগোষ্ঠী হাত ধোঁয়ার ন্যূনতম সুবিধাভোগী ?
গ্রামে বসবাসকারীরা শহরে বসবাসকারীদের তুলনায় হাত ধোঁয়ার কম সুযোগ সুবিধা প্রাপ্ত হয়। যেমন, কলোম্বিয়ায় গ্রামবাসী অপেক্ষা শহরবাসীর হাত ধোঁয়ার সুবিধা দ্বিগুন ( শহরে ৭৩% এবং গ্রামে ৩৫%)। বাংলাদেশে ও একই রূপ এবং যাথাক্রমে ৫১.১% ও ২৫.৭%।
একইরূপ দরিদ্র অপেক্ষা ধনীদের হাত ধোঁয়ার সুবিধা অনেক অনেক বেশী এবং কোন কোন ক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য রকম বেশী। যেমন, পাকিস্তানে ধনীদের সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোঁয়ার সুবিধা যেখানে ৯৪%, সেখানে দরিদ্রদের মাত্র ১৭%। বাংলাদেশে অবস্থা আরও নাজুক অর্থাৎ যাথাক্রমে ৬৪.৭%ও ৫.১%।
আফগানিস্তান, চাঁদ, এসওয়াসিনি এবং গাম্বিয়ার দরিদ্র মানুষের এ সুবিধা একেবারেই নাই। আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও কোন কোন স্থানে/ জনগোষ্ঠীর একই অবস্থা রয়েছে।
নিন্মে বিশ্বের যে সকল দেশে ৫০% এরও কম জনসংখার সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার সুবিধা বিদ্যমান নাই, এমন ৪২ টি দেশের শহর ও গ্রামের জনগনের হাত ধোঁয়ার প্রাপ্ত সুবিধার হারের চিত্র বার চার্টে উপস্থাপন করা হল :

নিন্মে বিশ্বের যে সকল দেশে ৫০% এরও কম জনসংখার সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার সুবিধা বিদ্যমান নাই, এমন ৪২ টি দেশের ধনী ও দরিদ্র জনগনের হাত ধোঁয়ার প্রাপ্ত সুবিধার হারের চিত্র বার চার্টে উপস্থাপন করা হল :

সার্ভে ডাটা সংগ্রহ ও মনিটরিং এ সমস্যা
সাবান ববহার দ্বারা মানুষের হাত ধোঁয়ার অভ্যাস মনিটরিং ও পরিসংখ্যানের কাজটি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। হাত ধোঁয়ার স্থানে সাবান ও পানির যথেষ্ঠ ব্যবস্থা রেখে দিলেও সকল পরিবার বা পরিবাররের সকল সদস্য যে হাত ধোঁয়ার প্রয়োজনীয় সময়ে সেগুলো ব্যবহার করে হাত ধৌত করবে এমন গ্যারান্টি নাই, কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনেসেফ যৗথভাবে বিশ্বব্যাপী যারা মনিটরিং ও সার্ভে করছে, তাদের মত হল ব্যক্তি বিশেষকে সাবান ও পানি ব্যবহার করে হাত ধৌত করছে কিনা বা করে কিনা – এর প্রাপ্ত জবাব অপেক্ষা হাত ধোঁয়ার প্রয়োজনীয় সময়ে হাত ধোঁয়ার স্থানে সাবান ও পানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করে মনিটরিং এ প্রাপ্ত ডাটা অধিকতর নির্ভরযোগ্য ও সঠিক।
মূল: Haruna Kashiwase