সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানির হাহাকার
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর, গাবুরা, রমজাননগর, কৈখালী, মুন্সিগঞ্জ ও গাবুরা ইউনিয়ন মূলত সুন্দরবনের উপকূলীয় জনপদ। এই উপকূলীয় এলাকায় যেদিকে চোখ যায়, শুধু পানি আর পানি। তবে খাওয়ার উপযোগী পানি একটুও নেই। এখানকার বেশিরভাগ পুকুর বা নলকূপের পানি লবণাক্ত।
বর্ষার সময় বৃষ্টির পানি ধরে রেখে মাস ছয়েক চালিয়ে নিতে পারলেও বছরের বাকিটা সময়জুড়ে সুপেয় পানির তীব্র সংকটে ভোগেন এখানকার মানুষ। স্থানীয় লোকজন মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে কিংবা ভ্যান ও সাইকেল চালিয়ে ছুটে বেড়ান খাওয়ার উপযোগী পানি সংগ্রহে।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বাসিন্দারা জানান, এখানকার কয়েক হাজার মানুষ নিরাপদ পানি সংগ্রহের জন্য প্রতিদিনই যুদ্ধ করেন। পানি পেতে পাড়ি দিতে হয় দীর্ঘপথ। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় তাদের সুপেয় পানি পাওয়া দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে।
সুপেয় পানির সংকটের কারণে উপকূলের মানুষ নানা সমস্যায় পড়ছেন। খাবার পানি, রান্নাবান্নাসহ দৈনন্দিন কাজে লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে অনেকেই উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। নারীদের ক্ষেত্রে খিঁচুনি, জরায়ুর সমস্যাসহ গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বাড়ছে।
সুপেয় পানির সংকটের বিষয়ে শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের বাসিন্দা আব্দুর রহিম সর্দার বলেন, পানির সংকটে আর জীবন বাঁচে না। শীতকাল আর গ্রীষ্মকালে খাবার পানির হাহাকার বেড়ে যায়। বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে সেগুলো কয়েকমাস ব্যবহার করা যায়।
এই পানির সমস্যা সমাধানে সরকারি-বেসরকারিভাবে নানা প্রকল্প হয়। কিন্তু তা আসলে পর্যাপ্ত নয়। ফলে ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়, জন্ডিস, চর্মরোগ এ এলাকার মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী। এই রোগগুলো এখানকার বেশিরভাগ মানুষ জীবনের অংশ হিসেবে মেনে নিয়েছে।
শ্যামনগরে আরেকজন বাসিন্দা লুৎফর বলেন, আমাদের এই দুঃখের কথা সবাই জানে। প্রতিবছরই কত শত আশ্বাস আসে। কিন্তু কোনও কিছু বাস্তবায়ন হয় না। মানুষকে দুই-তিন কিলোমিটার দূরে গিয়ে পায়ে হেঁটে খাবার সংগ্রহ করতে হয়। আবার অনেককে এক কলসি পানি নিতে মাইলের পর মাইল যেতে হয়।
কিন্তু খাবার পানি মেলে না। সরকারি প্রকল্পের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে এই বাসিন্দা বলেন, আমাদের সমস্যা সমাধানে সরকারি প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তদারকি করার মতো কেউ নেই। ফলে অধিকাংশ প্রকল্প নামমাত্র পড়ে আছে।
এসব প্রকল্প আসল অর্থে কোনও কাজের নয়। শুরু থেকেই নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। সরকারি প্রকল্পগুলো যদি ঠিকমতো কার্যকর হতো তাহলে পানির সমস্যা অনেকাংশে লাঘব হতো।
সুপেয় পানির সংকট নিরসনে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও দূষণের কারণে নিরাপদ পানি পাওয়া চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সহজেই সমুদ্রের লবণাক্ততা লোকালয়ে চলে আসছে।
এছাড়া ফারাক্কা বাঁধ ও তিস্তা থেকে পানি প্রত্যাহার করায় দেশে পানিপ্রবাহ কমছে। দেশের ভেতরে পানির ব্যবহার বেড়েছে। সব মিলিয়ে পানি ব্যবস্থাপনা এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখনই সরকারি বেসরকারি যেকোনও উদ্যোগে পর্যাপ্ত নিরাপদ পানির ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দেন বিশেষজ্ঞরা।
ভূপৃষ্ঠের ওপরের বিভিন্ন উৎসের পানি শোধনের মাধ্যমে মানুষের মাঝে সরবরাহ করার জন্য সরকারিভাবে সাতক্ষীরা জেলায় ১১৫টি পিএসএফ (প্রেশার স্যান্ড ফিল্টার) বসানো রয়েছে। শ্যামনগরে সুপেয় পানির জন্য সরকারি যে কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছ তার অধিকাংশ জায়গায় কোনও পানি পাওয়া যাচ্ছে না।
স্থানীয়দের দাবি, শ্যামনগরে যেসব পিএসএফ আছে তা বেশিরভাগ শুরু থেকেই নষ্ট। হাতেগোনা যে কয়টি ভালো ছিল তাতে ও এখন পানির সংকট।