সাইকেলের উপর কর প্রত্যাহার করার দাবীতে ঢাকায় বনাঢ্য সাইকেল র্যালী
৩রা জুন বিশ্ব সাইকেল দিবসের প্রাক্কালে আজ ২রা জুন, ২০২৩ তারিখে সাইকেল ও সাইকেল এর যন্ত্রাংশের উপর আরোপিত কর প্রত্যাহারের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব, ব্যয়সাশ্রয়ী, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ী এবং সু-স্বাস্থ্য গঠনে অবধান রাখা বাহনটিকে দেশের সাধারণ নাগরিকদের ক্রয় সীমায় রাখার দাবীতে “বাইসাইকেলের উপর কর প্রত্যাহার করুন” এই স্লোগানে রাজধানী ঢাকায় এক বনাঢ্য সাইকেল র্যালী অনুষ্ঠিত হয়।
র্যালীটি ঢাকার ধানমন্ডির ছায়ানট সংস্কৃতিক ভবনের সম্মুখ থেকে শুরু হয়ে জিগাতলা, সাইন্স ল্যাব, নিউমার্কেট, নীলক্ষেত মোড়, কেন্দ্রিয় শহীদ মিনার হয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাব এসে শেষ হয়।
ইনস্টিটিউট অব ওয়েলবীইং বাংলাদেশ এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত র্যালীতে আয়োজক হিসাবে ছিলেন স্কেটিং ৭১, কারফ্রি সিটিস এলায়েন্স বাংলাদেশ, ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট এবং সহ-আয়োজক হিসাবে অংশগ্রহণ করে ঢাকা আইডিয়াল ক্যাডেট স্কুল, ধানমন্ডি ট্যুরিস্ট সাইক্লিস্ট, সূর্য শিশির, বাংলাদেশ সাইকেল লেন বাস্তবায়ন পরিষদ, গ্রীণ পেইজ। ইসলামিক ইউনিভাসির্টি অব টেকনোলজি, ব্র্যাক ইউনিভাসির্টি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ব বিদ্যালয়সহ আরো অন্যান্য বিশ্ব,বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই র্যালীতে অংশগ্রহণ করেন।
বর্তমানে চলমান রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের পেক্ষাপটে খাদ্য জ্বালানীসহ সকল নিত্যপণ্যের দাম সারা বিশ্বেই হুহু করে বেড়েই চলেছে। এহেন পরিস্থতিতে উচ্চ মূল্যে জ্বালানি তেল কেনার কারণে আমাদের দেশের অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ অবস্থায় জ্বালানী বিহীন যানবাহন হিসাবে সরকার সাইকেলে চলাচলে উৎসাহ প্রদানের উদ্যোগ গ্রহন করতে পারত।
কিন্তু সরকারের বর্তমান রাজস্ব নীতির কারণে পরিবেশবান্ধব জ্বালানী সাশ্রয়ী বাহনটি সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। উল্লেখ্য যে, পূর্ব হতেই সাইকেল তৈরির খুচরা যন্ত্রাংশের উপর শতকরা ৫৮ শতাংশ কর আরোপ রয়েছেই।
অধিকন্ত, গতকাল ১লা জুন, ২০২৩ তারিখে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটেও নতুন করে এখাতে মূল্য সংযোজন কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা সাইকেলের মূল্য আরও বৃদ্ধি করবে। ফলশ্রুতিতে পরিবেশ বান্ধব, জ্বালানীবিহীন এ যানটি ক্রয়ে ও ব্যবহারে সাধারণ মানুষ নিরাৎসাহী হবে।
এমন প্রেক্ষাপটে সাইকেল তৈরির খুচরা যন্ত্রাংশের উপর আরোপিত কর হ্রাস এবং বাজেটে প্রস্তাবিত মূল্য সংযোজন কর প্রত্যাহারের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব, ব্যয় সাশ্রয়ী ও নিরাপদ বাহনটিকে সবার ক্রয় ক্ষমতার মাঝে নিয়ে আসার বিষয়টি সরকারের দৃষ্টিগোচর করার জন্যই মূলত র্যালটির আয়োজন করা হয়।
র্যালীটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পৌঁছার পর পরিবেশ ও জলবায়ু সংশ্লিষ্ট নিউজ পোর্টাল “গ্রীণ পেইজ” এর উপদেষ্টা প্রকৌশলী ও পরিবেশবিদ মোঃ মাহফুজুর রহমানের সভাপতিত্বে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য প্রদান করেন বাংলাদেশ সাইকেল লেন বাস্তবায়ন পরিষদের সভাপতি মো: আমিনুল ইসলাম টুব্বুস, ইনস্টিটিউট অব ওয়েলবীইং বাংলাদেশ এর প্রজেক্ট ম্যানেজার বরনী দালবত, ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট এর কমিউনিকেশন অফিসার সানজিদা, ঢাকা আইডিয়াল ক্যাডেট স্কুলের অধ্যক্ষ, এম. এ. মান্নান মনির প্রমূখ। সংক্ষিপ্ত বক্তব্য পর্বটি সঞ্চালনা করেন ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট এর সহকারী প্রকল্প কর্মকর্তা শারিরিক প্রতিবন্ধী বরেণ্য মোঃ মিথুন।
সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বাংলাদেশ সাইকেল লেন বাস্তবায়ন পরিষদের সভাপতি মো: আমিনুল ইসলাম টুব্বুস বলেন, সাইকেল নিরাপদ ও ব্যয় সাশ্রয়ী একটা বাহন। বর্তমানে বাংলাদেশ একটা কঠিন সময়ে পার করছে। বিশ্বের সকল দেশের মত আমাদের দেশেও দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে মানুষ অনেক কষ্টে আছে।
তার উপর নাগরিকদের প্রতিদিন অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে হচ্ছে যাতায়াতে। সাইকেল ব্যবহার করে তারা প্রতিদিন অনেক অর্থ সাশ্রয় করতে পারত এবং সাথে পরিবেশেরও উন্নত হতো। এ পরিস্থিতিতে সাইকেলের উপর হতে কর হ্রাস এখন সময়ের দাবি এবং নারীদেরকে সাইকেল চালনায় উদ্ভূদ্ধ করার লক্ষ্যে সাইকেল লেন বাস্তবায়ন করা হলে সকল সাইক্লিস্টরাই সুবিধা পাবে।
ইনস্টিটিউট অব ওয়েলবীইং বাংলাদেশ এর প্রজেক্ট ম্যানেজার বরনী দালবত সাইকেল র্যালীতে আগত সকল সাইক্লিষ্টদের স্বাগত জানান। অত:পর পরিবেশ এর উপর যান হিসাবে সাইকেলের গুরুত্ব তুলে ধরেন বক্তব্য প্রদার করেন।
ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট এর কমিউনিকেশন অফিসার শানজিদা আক্তার তার বক্তব্যে পরিবেশ বান্ধব ও ব্যয় সাশ্রয়ী যানটি সাধারণ মানুষের ক্রয় সীমার মধ্যে রাখার জন্য সরকারের কাছে দাবী জানান।
তিনি বলেন রাস্তায় বের হলেই কালো ধোঁয়া, বায়ু দুষণ, শব্দ দূষণ এ শহরবাসী এখন মানষিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তিনি আরো বলেন যে, মার্চ, এপ্রিল ও মে’২০২৩ মাসের বেশীরভাগ সময়েই ঢাকার বায়ু দূষণ বিশ্বে ১ম স্থান দখল করেছে। এর পরিত্রাণ হতে রক্ষায় আমাদেরকে জ্বালানী চালিত যানবাহনের পরিবর্তে জ্বালানী বিহীন যান হিসাবে সাইকেলের ব্যবহার বাড়াতে হবে।
ঢাকা আইডিয়াল ক্যাডেট স্কুলের অধ্যক্ষ, এম. এ. মান্নান মনির বলেন, ঢাকা মহানগরীতে ব্যায়ামের খুব কম সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে সাইকেল চালনা হতে পারে একটা ভাল সমাধান। কিন্তু অতি উচ্চহারে কর আরোপ করার কারণে মানুষ এখন আর সাইকেল কিনতে পারছে না। তাই অবিলম্বে সাইকেলের খুচরা যন্ত্রাংশের উপর হতে আরোপিত ও প্রস্তাবিত কর হ্রাস করার মাধ্যমে এই বাহনটিকে সাধারণ মানুষের নাগালে নিয়ে আসার জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
গ্রীণ পেইজ এর উপদেষ্টা প্রকৌশলী ও পরিবেশবিদ মোঃ মাহফুজুর রহমান সভাপতির বক্তব্যে যান হিসাবে সাইকেল এর গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সাইকেল ব্যয় সাশ্রয়ী, পরিবেশ বান্ধব এবং সুস্বাস্থ গঠনের সহায়ক। সাইকেল পরিবেশ বান্ধব তার কারণ, ইহা জ্বালানীবিহীন যান।
ফলে সাইকেল চালনায় কোন প্রকার জ্বালানীর ব্যবহার হয় না বিধায় গ্রীণহাউজ গ্যাস তথা কার্বণ ডাই অক্সাইড (CO2), মিথেন (CH4), নাইট্রাস অক্সাইড (NO2), গ্রাউন্ড লেভেল ওজন (O3) এবং বিষাক্ত হেভী মেটালসমূহ যেমন, সিসা লিড (Pb), মার্কারী (Hg), নিকেল (Ni), কেডমিয়াম (Cd) ইত্যাদি নিসঃরণ ঘটায় না বিধায় বায়ু দুষণ করে না। সাইকেল চালনায় মানুষের সুস্বাস্থ্য গঠিত হয় বিধায় স্বাস্থ্যখাতে ব্যক্তিগতভাবে এবং জাতিয়ভাবে ব্যয় হ্রাস পায়, মানুষের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং দীর্ঘদেহী ও দীর্ঘজীবি হয়।
তিনি বলেন, অনেকের ধারণা দেশের বিদ্যমান সড়কগুলো এত কম প্রসস্থ যে এমনিতেই রিক্সা, ভেন, মোটর গাড়ীর জ্যাম লেগে থাকে, সে সড়কে আলাদা সাইকেল লেন হওয়ার চিন্তাটি একেবারে অবাস্তব।
তিনি বলেন তাদের এ ধারণাটি সম্পূর্ণ ভূল, কারণ সাইকেল ব্যবহার যত বাড়বে, সড়কে গণপরিবহন যেমন বাস, রিক্শার মত বাহনগুলোর চাপ তত কমবে। ফলে ক্রমান্বয়ে বিদ্যমান সড়কগুলোই ধীরে ধীরে অন্য যানের পরিবর্তে সাইকেল লেন এ পরিবর্তণ ঘটবে।
প্রকৌশলী ও পরিবেশবিদ মোঃ মাহফুজুর রহমান আরো বলেন, আমাদের দেশে যান হিসাবে সাইকেলের ব্যবহারের বড় সমস্যাটি হলো সাইকেল এর নিরাপদ পার্কিং এর অভাব।
তিনি বলেন, পার্ক বলুন, অফিস আদালত বলুন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কাঁচাবাজার বলুন কোথাও সাইকেল এর নিরাপদ পার্কিং নাই। এমন কি বাসা বাড়ী, এপার্টমেন্ট ব্লিডিংসমূহে কারপাকিং থাকলেও বাচ্চাদের পর্যন্ত সাইকেল পার্কিং রাখা হয়না।
যদি রাস্তার মোড়ে মোড়ে, সাধারণ জনসমাগম স্থলে, হাটে বাজারে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, অফিস আদালতে নিরাপদ সাইকেল পার্কিং এর ব্যবস্থা করা হয়, তবে এ দেশে সাইকেল এর ব্যবহার বর্তমানের চেয়ে নূন্যতম ৫০% বৃদ্ধি যা ক্রমান্বয়ে সাধারণ জানবাহনের ৮০% এ উন্নত হতো। তখন সাইকেল এর জন্য আলাদা লেন করার প্রয়োজন হতো না, আন্তজেলা সড়কগুলো ব্যতীত সকল সড়কই সাইকেল লেন এ পরিবর্তিত হতো। এমন টি হলে পরিবেশের উন্নয়নের সাথে সাথে জীবাশ্ম জ্বালানী চালিত যানবাহন ও জীবাশ্ম জ্বালানীর বাবদ আমাদের দেশের কত বৈদিশক মুদ্রা সাশ্রয় হতো তা চিন্তা করতেও অবাক হতে হয়।
ঐ সাশ্রয়কৃত বৈদেশিক মুদ্রা দ্বারা আমারা খাদ্য ক্রয়সহ শিক্ষা গবেষণায় বিনিয়োগ করতে পারি, উন্নত জীবন গড়ার লক্ষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক খাতে ব্যয় বাড়িয়ে উন্নত জাতীগঠণের পথে এগিয়ে যেতে পারি।
জাতীয় প্রেস ক্লাব চত্তরে সাইকেল র্যালীর সমাপনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জনপ্রশাসন বিভাগের প্রফেসর, ডাঃ. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ,বাং লাদেশ গ্রীন পার্টির চেয়ারম্যান এস,এম,ফরিদ উদ্দিন মিয়াজী।
তাঁরা তাঁদের বক্তব্যেপরিবেশ উন্নয়নে এবং ব্যয় সাশ্রয়ী যান হিসাবে সাইকেলে এর ব্যবহার বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালনে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
র্যালীতে অংশগ্রহণকারী সাইক্লিষ্টদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে এবং আপ্যায়নের মাধ্যমে র্যালীর কাজ সমাপ্ত হয়।