সমুদ্র দূষণে মাছ ও জীববৈচিত্র্য ঝুঁকির মুখে
মানবসৃষ্ট যে সকল কারণে পৃথিবী ধ্বংসের সম্মুখীন এর মধ্যে অন্যতম হলো সমুদ্র দূষণ। গত কয়েক দশকে এই বিরামহীন দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। বেঁচে থাকার তাগিদে ইচ্ছাকৃত হোক কিংবা অনিচ্ছাকৃত হউক মানুষ পরিবেশের সাথে সাথে সমুদ্র দূষণ করেই চলেছে।
কখনো কখনো দূষণ বিষয়ে অসচেতনতাও এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। সমুদ্র দূষণ মূলত সরাসরি ঘটে না বরং পরোক্ষ ভাবে দূষিত হয় বেশি।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য ময়লা-আবর্জনা, প্লাস্টিকের বোতল, অপচনশীল বস্তু, রাসায়নিক পদার্থ যত্রতত্র ফেলার কারনে সেগুলো কৃষিকাজের সেচের পানি, বৃষ্টির পানির সাথে মিশে গিয়ে আমাদের আশে পাশের পুকুর, খাল, বিল ও নর্দমায় পতিত হয় এবং সেগুলো পরবর্তিতে পানিতে ভাসতে ভাসতে নদী নালা হয়ে ধীরে ধীরে ধীরে একসময় সমুদ্রে গিয়ে পতিত হয়।
বর্তমানে এমন অনেক পদার্থ রয়েছে যা সরাসরি বা পরোক্ষ ভাবে সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হচ্ছে যা ওপেন ডাম্পিং নামে পরিচিত। মাছ ধরার নৌকা, তেলবাহী জাহাজ ও অন্যান্য জলযান সমুদ্রে সরাসরি বিভিন্ন দূষণকারক পদার্থ নিক্ষেপ করছে।
আমাদের নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাধি এখন প্লাস্টিকে মোড়ানো প্লাস্টিক দূষণের ফলে পুরো পৃথিবীর মানুষ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখে। অপচনশীল পলিথিনের ব্যবহার পরিবেশের ক্ষতি করছে।
পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতল পরিবেশের সাথে মিশে গিয়ে পরবর্তিতে সমুদ্রে জমা হয়। এর ফলে পরিবেশের সাথে সাথে ক্ষতি হচ্ছে সামুদ্রিক জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণিকূলের। সমুদ্র মৎস আহরণ কমে যাচ্ছে। মাছের প্রজনন ক্ষমতা লোপ পাচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে জীব বৈচিত্র্য।
সমুদ্রে অসংখ্য প্লাস্টিক বোতল, পলিথিন ব্যাগ, প্লাস্টিকের বাক্স, মাছের বাক্স, যানবাহনের টায়ার, জাল, দড়ি ও অন্যান্য প্লাস্টিক জাতীয় বর্জ্য দেখতে পাওয়া যায়। অনেক ক্ষুদ্রাকৃতির প্লাস্টিক দ্রব্যাদিও রয়েছে যা মাইক্রো প্লাস্টিক নামে পরিচিত।
আমরা বলতে পারি নদী দূষণ, সমুদ্র দূষণের শেষ পরিনতি পরিবেশ দূষণ এবং সমুদ্র থেকে অনেক প্রজাতির মাছ ও জলজ উদ্ভিদ চিরতরে হারিয়ে যাওয়া। প্রাচীন কাল থেকেই দেখা যায় বেশির ভাগ শহর-নগর-বন্দর তৈরি হতো নদীর তীরে এবং সেখানেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা হতো।
তবে যুগের পরিবর্তনে শহর গুলোতে মানুষ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে আর সেই সাথে বাড়ছে উৎপাদিত বর্জ্যের পরিমাণ কিন্তু সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে না সে অনুপাতে যা সত্যিই পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।
বর্তমান যুগে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরনের প্রধান মাধ্যম কৃষি কাজে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন এসেছে। অল্প জমিতে অধিক ফলনের আশায় কৃষকেরা বিভিন্ন কীটনাশক ব্যবহার করে থাকে।
পরবর্তিতে এসব ক্ষতিকর কীটনাশক বৃষ্টির পানির সাথে মিশে গিয়ে নদীনালাবিলের পানিতে মিশে যায় এবং একপর্যায়ে তা সমুদ্রে পতিত হয়। সমুদ্রে যখন দূষণের পরিমাণ বেশি বেড়ে যায় তখন সমুদ্রে মৃত অঞ্চলের সৃষ্টি হয়।
এটি এমন একটি এলাকা যেখানে দূষণের ফলে অক্সিজেনের ঘাটতি হয় এবং সে স্থানের কোনো প্রাণী বেঁচে থাকতে পারেনা। বৈজ্ঞানিক ভাষায় বলা হয় ঐ স্থানে নাইট্রোজেন ও ফসফরাসের পরিমান বেড়ে যাওয়ার ফলে এটি ঘটে। ডেড জোন সৃষ্টি হওয়ার কিছু অন্যতম কারন রয়েছে।
প্রাকৃতিকভাবে কৃষিকাজে ব্যবহৃত সার মিশ্রিত মাটি ও পানি, শহর অঞ্চল হতে নিষ্কাশিত দূষিত পানি, ক্ষতিকর কেমিকেল, তেল নিঃসরণ ইত্যাদি। অন্যদিকে সমুদ্রে চলাচল করা জাহাজের ইঞ্জিন ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ চালনায় ব্যবহৃত তেল ও সমুদ্রে নিঃসরণ করা হয়।
আর এ জাতীয় নিঃসরণ নাবিকদের অবহেলায় অথবা সম্পুর্ণ ইচ্ছাকৃত ভাবেই ঘটতে পারে। এমনকি আন্তর্জাতিক আইন ও নীতিমালা প্রনয়ণের পরেও তা রোধ করা সম্ভব হয়নি।
আজকাল সমুদ্রে ভ্রমণ ব্যপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ধনী ও বিলাসী মানুষদের অবসরযাপনের নিমিত্তে সমুদ্রের বুকেই তৈরী করা হচ্ছে বিলাসবহুল হোটেল, রিসোর্ট ও কৃত্রিম দ্বীপ।
সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর নিজস্ব কিছু জাহাজ ভ্রমণকার্য পরিচালনা করে। এ সকাল জাহাজের যাত্রীদের দৈনন্দিন ব্যবহার্য বিপুল পরিমাণ বর্জ্য সরাসরি সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। সমুদ্র ভ্রমণ দোষের নয় কিন্তু সমুদ্র দূষণ কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সমুদ্র দূষণ তথা পরিবেশ দূষণ মারাত্মক অপরাধের শামিল।
মানব জীবনের সাথে সমুদ্রের এক নিবিড় সম্পর্ক বিরজমান। সমুদ্রকে কোনভাবেই উপেক্ষা করা সম্ভব নয় আবার সমুদ্রের উপর নির্বিচার অত্যাচারও কাম্য নয়।
সমুদ্র মানুষের উপকারের জন্যই সৃষ্টি করেছেন মহান স্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। সমুদ্র দূষণের অন্যতম কারন হলো প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্য। প্লাস্টিক বর্জ্য পদার্থ সমুদ্রের সৌন্দর্য নষ্টের পাশাপাশি সমুদ্রের বাস্তুসংস্থানের ক্ষতি সাধন করে।
মানুষের এসকল অবহেলা সমুদ্রকে ভয়ংকর রুপ ধারণে বাধ্য করছে। সমুদ্র হাজার হাজার প্রজাতির প্রাণীর বাসস্থল এবং মানুষের জন্য প্রকৃতিক সম্পদের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
পৃথিবীর আনাচে-কানাচে প্রতি মুহুর্তে কোন না কোন স্থানে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক বোতল, পলিথিন, চিপসের প্যাকেট আর স্ট্র এর শেষ ঠিকানা হচ্ছে সমুদ্র।
এই প্লাস্টিক দ্রব্য গুলো বছরের পর বছর সমুদ্রে ভাসতে থাকে আর ঢেউ এর মাধ্যমে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যায়। যার ফলে সমুদ্রের উপর একটি আচ্ছাদন তৈরি করে। সামুদ্রিক প্রাণীর একটা বড় অংশ সাধারনত খাদ্যের জন্য সমুদ্রে ভাসমান ক্ষুদ্র প্রাণী কণা এবং উদ্ভিদকণার উপর নির্ভরশীল।
কিন্তু বিশ্ব জুড়ে প্লাস্টিকের একটা বড় অংশ যখন সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছে তখন তা বেশ ভয়ংকর ভাবেই এসকল উদ্ভিদের উৎপাদন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ করছে। যার ফলে সামুদ্রিক প্রাণীদের খাদ্য সরবরাহের প্রাথমিক ধাপটি বাঁধার মুখে পতিত হচ্ছে।
যদিও লবণাক্ত হওয়ার কারনে সমুদ্রের পানি পানযোগ্য নয় তবুও পানচক্রখনিজ লবনের চাহিদা পূরণ, জীববৈচিত্রের রক্ষায় সমুদ্রের জলের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণঅবদান।
আমাদের প্রতিদিন ছোট ছোট অবহেলার কারনে সমুদ্র প্রতিনিয়ত ধ্বংসের মুখে পড়ছে। তাই আমাদেরকে দৈনন্দিন ব্যবহারের বর্জ্যসহ সকল প্রকারের বর্জ্য নিষ্কাশনে সচেতনতা অবলম্বন করা উচিৎ।
মানুষ ইচ্ছাকৃত ভাবে সব সময় দূষণ করে না। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে মানবসৃষ্ট দূষণ উৎপন্ন হয়। সমুদ্র এখনো পরিপূর্নভাবে ভাগাড়ে পরিণত হয়নি।
কিন্তু এভাবে সমুদ্র দূষণ চলতে থাকলে সমুদ্রের যতটুকু অঞ্চল দূষিত হয়েছে এর বিরুপ প্রতিক্রিয়া সামুদ্রিক জীবের পাশাপাশি স্থলভাগের জীবনকেও মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে।
সমুদ্র পৃথিবীর রক্ত প্রবাহের সমতুল্য। রক্ত প্রবাহ দূষিত হলে যেমন মানুষ বাঁচতে পারে না, তেমনি সমুদ্র দূষিত হলে পৃথিবী বাঁচবে না। তাই সমুদ্র দূষণ কমাতে ব্যক্তিগত, স্থানীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।