সমগ্র বিশ্বই এখন সোচ্চার জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে
জলবায়ুর পরিবর্তন নিয়ে সমগ্র বিশ্বই এখন সোচ্চার। আগুনের আঁচ যখন নিজেদের উপরও আসিয়া পড়ে, তখন তাহাকে আর অগ্রাহ্য করা যায় না।
জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত অসংখ্য গবেষণা প্রবন্ধ-প্রতিবেদন প্রতিনিয়তই প্রকাশিত হইতেছে উন্নত বিশ্বের গবেষণা-জার্নালে। ইহা এখন আর সূক্ষ্ম পর্যায়ে নাই, আমাদের সাধারণ অনুভূতি-ইন্দ্রিয় দিয়াই অনুধাবন করা যায়—জলবায়ু পরিবর্তন কীভাবে জাঁকিয়া বসিতেছে আমাদের পরিবেশে।
সেই শত বছর পূর্বে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাহার সংগীতের মাধ্যমে বলিয়া গিয়াছেন—‘নাই রস নাই, দারুণ দাহনবেলা। খেলো খেলো তব নীরব ভৈরব খেলা।’
অর্থাৎ প্রকৃতি জুড়িয়া দারুণ দহনবেলার নীরব ভৈরব খেলা আবহমান কাল ধরিয়াই হইতেছে। বাংলাদেশকে বলা হইত ষড়্ঋতুর দেশ। মাত্র কয়েক দশক পূর্বেও ছয়টি ঋতু তাহার স্পষ্ট ছাপ রাখিত। এখন মনে হয় যে, বছরের অর্ধেক সময়ই গ্রীষ্মকাল। উহার ফাঁকে ফাঁকে যখন-তখন বর্ষা নামে।
পৃথিবীর উষ্ণায়ন এমনই এক ভয়ংকর বিষয় যে, উহাতে বাতাসে জলীয় বাষ্প ধরিয়া রাখিবার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ইহার সহিত জলাভূমি হইতে বাষ্পীভবনের মাত্রাও বাড়ে।
ফলে বৃষ্টি নাই তো নাই, আবার যখন বৃষ্টি হয় তখন যেন মেঘভাঙা বর্ষণে দ্রুত তলাইয়া যায় সকল কিছু। অর্থাৎ আবহাওয়া হইয়া উঠিতেছে কন্ট্রাস্ট—অতি খরা কিংবা অতিবৃষ্টি। এই উভয় বিষয়টিই অত্যন্ত বিপজ্জনক।
সমগ্র বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ ছাপ দেখা যাইতেছে। খরা, বন্যা ও দাবদাহের প্রভাব পড়িতেছে সকল মহাদেশের মানুষের উপর।
এই দুর্যোগে ক্ষতি হইতেছে কোটি কোটি ডলার। ডব্লিউএমও তাহাদের গত বছরের প্রতিবেদনে জানাইয়াছে—দাবদাহের কারণে গত বছর ইউরোপ জুড়িয়া মৃত্যু হইয়াছিল কমপক্ষে ১৫ হাজার ৭০০ মানুষের।
প্রকৃতপক্ষে জলবায়ু পরিবর্তন একটি জটিল এবং চলমান প্রক্রিয়া, যা লক্ষ লক্ষ বছর ধরিয়া ক্রমশ সংঘটিত হয়। সৌর বিকিরণের তারতম্য, আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপ এবং পৃথিবীর কক্ষপথের গতিবিধি প্রভৃতি ইহার প্রভাবক হিসাবে কাজ করে, কিন্তু সাম্প্রতিক ইতিহাসে মানুষের কার্যকলাপ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ হইয়া উঠিয়াছে।
১৮ হইতে ১৯ শতকে শিল্পবিপ্লব ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের সলতেতে অগ্নিসংযোগের সূচনা। এই শিল্পায়নের হাত ধরিয়াই জীবাশ্ম জ্বালানি (কয়লা, তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস) ব্যবহারের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলে প্রচুর পরিমাণে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গত হইতে শুরু করে। ২০ শতকের গোড়ার দিকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পাইতে শুরু করে।
জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত আন্তঃসরকার প্যানেল (আইপিসিসি) উল্লেখ করিয়াছে যে, বিগত শতাব্দীতে বিশ্বব্যাপী গড় পৃষ্ঠের তাপমাত্রা অভূতপূর্ব বৃদ্ধি পাইয়াছে—যাহা মূলত মনুষ্য-সৃষ্ট। উল্লেখ্য যে, জলবায়ু বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাও ঘটে বিংশ শতকে।
এই সময় জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি বৈজ্ঞানিকভাবে বোঝার উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটে। বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর জলবায়ু ব্যবস্থা, গ্রিনহাউজ গ্যাস এবং মানুষের ক্রিয়াকলাপের প্রভাবগুলি লইয়া গবেষণা করিতে শুরু করেন।
ইহার ধারাবাহিকতায় ১৯৫০-১৯৬০-এর দশকে চার্লস ডেভিড কিলিংয়ের মতো বিজ্ঞানীরা বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের ঘনত্বের পরিমাপ শুরু করেন।
১৯৮৮ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের মূল্যায়ন করিবার জন্য জাতিসংঘ কর্তৃক আইপিসিসি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯২ সালে রিও ডি জেনেরিওতে আর্থ সামিট জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের নেতৃত্ব দেয়।
১৯৯৭ সালে কিয়োটো প্রোটোকল, গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন কমাইতে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি গৃহীত হয়। ২০০০ সাল হইতে বর্তমান অবধি ক্রমাগত উষ্ণায়ন, চরম আবহাওয়ার ঘটনা এবং মেরু অঞ্চলে বরফ গলনের ঘটনা জলবায়ু পরিবর্তনের অশনিসংকেত হিসাবে গুরুত্ব পায়।
২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তিতে প্রায় সমস্ত দেশ সম্মত হইয়াছে—বৈশ্বিক উষ্ণতাকে প্রাক-শিল্পযুগের দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে সীমাবদ্ধ রাখা। অতঃপর আমরা বিগত কয়েক বছরে জলবায়ু পরিবর্তন স্পষ্ট আলামত লক্ষ করিতেছি বিশ্বব্যাপী।
একটিই ছাদ এই ধরিত্রীর। নরকের আগুনে এখনো ঘি ঢালা হইতেছে—অধিক করিয়া উত্তাপ ছড়াইতেছে বিশ্ব জুড়িয়া। প্রতিটি দেশ নিজ নিজ পরিসরে নিজেদের দায়িত্বটি একনিষ্ঠভাবে পালন করিলে ইহার লাগাম হয়তো টানা যাইবে।
যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ প্রতি বছরই বাড়িবে, সুতরাং এই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সঠিক পদক্ষেপ ও প্রস্তুতিও গ্রহণ করা আবশ্যক।