লবণপানির আগ্রাসন বাড়ছে সুন্দরবনে, হুমকিতে জীববৈচিত্র
বিশ্বের একমাত্র মিঠাপানির বাদাবন (ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট) সুন্দরবনে লবণপানির আগ্রাসন বাড়ছে। বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে চিহ্নিত এ বনে মিঠাপানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে। ফলে মিঠাপানিনির্ভর বৃক্ষ ও মাছ মারা যাচ্ছে। অতিরিক্ত লবণাক্ততা বদলে দিচ্ছে বনের জীববৈচিত্র্য।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীগুলোর উৎসস্থল বা উজান থেকে পানি প্রত্যাহার এই সমস্যার মূল কারণ। সঙ্গে নতুন বিপদ হিসেবে যোগ হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় কম লবণসহিষ্ণু গাছগাছালি মারা যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনে জোয়ারের পানির উচ্চতা বেড়ে বনভূমি তলিয়ে যাওয়ায় মাটির ‘বন্ডিং’ কমে ভাঙনে ছোট হচ্ছে বন।
সুন্দরবন গবেষক ও লেখক গৌরাঙ্গ নন্দী বলেন, সুন্দরবনের অন্যতম প্রধান পশুর নদ, শিবসা, রায়মঙ্গল, কপোতাক্ষসহ অনেক নদ–নদী শুকিয়ে মরতে বসেছে। ছোট অনেক নদী-খাল মরে শুকিয়ে গেছে।
সুন্দরবন অঞ্চলের নদীগুলোর সঙ্গে উত্তরের নদীগুলোর অনেক আগেই বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছিল; গঙ্গা, পদ্মা, গড়াইয়ের মাধ্যমে একটু টিকেছিল। কিন্তু ফারাক্কা বাঁধের পর সেটিও বাধাগ্রস্ত হয়। উজানে মিঠাপানির প্রবাহ বাড়লে লবণাক্ত পানির প্রবাহ কমবে।
সুন্দরবনের বিভিন্ন নদ–নদীর লবণাক্ততা নিয়ে ২০২০ সালে গবেষণা করে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ডিসিপ্লিন (বিভাগ)। ফলাফলে দেখা যায়, পশুর নদে ২০২০ সালে শুষ্ক মৌসুমে লবণাক্ততার সর্বোচ্চ পরিমাণ ছিল ২২ দশমিক ৬ পিপিটি (পার্টস পার থাউজেন্ড)। যদিও ২০১০ সালে তা ছিল ১৭ দশমিক ৫ পিপিটি।
গবেষকেরা জানান, সাধারণভাবে উপকূলীয় এলাকার নদীতে লবণাক্ততা থাকার কথা দুই থেকে পাঁচ পিপিটি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও উজানের মিঠাপানির প্রবাহ কমায় অনেক আগে থেকেই সুন্দরবনের পানি ও মাটিতে লবণাক্ততা মাত্রা ছাড়িয়েছে।
পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পলিমাটি। ২০১৩ সালে পশুর নদের হাড়বাড়িয়া এলাকায় পলির পরিমাণ ছিল ৯ সেন্টিমিটার। ২০১৯-২০ সালে তা ২২ সেন্টিমিটারে দাঁড়ায়। নদের করমজল এলাকায় এক দশক আগে ১৯ সেন্টিমিটার পলি থাকলেও এখন বেড়ে ৩৯ হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বনের বিভিন্ন নদীর পানির উচ্চতা বাড়ছে। সম্প্রতি সুন্দরবনের শিবসা নদীর পাড় থেকে জোয়ারের সময় বনভূমির অধিকাংশ পানিতে তলিয়ে থাকতে দেখা গেছে।
আড়ুয়া, শিবসা, আন্ধারমানিক, বজবজা, শাকবাড়িয়া নদীপাড়ের বনভূমিতেও একই অবস্থা দেখা যায়। শিবসা, মরজাত, আড়পাঙ্গাশিয়া, হংসরাজ নদের পাড়ে অসংখ্য গাছ উপড়ে পড়েছে।
বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের খুলনা বিভাগীয় কর্মকর্তা আ স ম হেলাল সিদ্দিকী বলেন, তাঁরা সুন্দরবনকে স্বল্প, মধ্য ও উচ্চ লবণাক্ত এলাকায় ভাগ করেছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি গবেষণায় দেখা গেছে, বনের সর্বত্র উচ্চ লবণাক্ত হয়ে গেছে। কম লবণসহিষ্ণু সুন্দরী, পশুরসহ ১০টি গাছের চারা গজানোর হার কমেছে।
বনের গাছগুলো নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। অন্যদিকে গেওয়াগাছ অনেক বাড়ছে। ১৯৮৫ সালে বনে ১৬ শতাংশ গেওয়াগাছ থাকলেও এখন বনের ৫০ ভাগই গেওয়া গাছ। গেওয়া গাছের পাতা ও বীজে আঠা থাকায় হরিণ বা অন্য প্রাণী তা খায় না। এতে বন্য প্রাণীর ওপরও প্রভাব পড়ছে।
বন বিভাগের বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা তন্ময় আচার্য্য বলেন, বনে জলাভূমির পাশে আগের মতো লতাগুল্ম জন্মাতে পারছে না। লবণাক্ততা বৃদ্ধি বন্য প্রাণীর ওপর কেমন প্রভাব ফেলছে, তা জানতে এবং এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বিস্তর গবেষণা প্রয়োজন।