প্লাস্টিক কণা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক উপাদান। এটি মানুষের শরীরে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে। স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের তথ্যমতে, প্লাস্টিক কণা শুধুমাত্র মানুষের ক্ষেত্রেই নয় যেকোনো প্রাণীর জন্যও এটি ক্ষতিকারক। কৃত্রিম এই উপাদানটি ক্যানসার, শ্বাসকষ্ট, হজমের সমস্যাসহ নানা ধরনের রোগের কারণ হতে পারে, যা নিয়মিতভাবে খাবারের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করলে আরও নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে মানুষের।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের চার গবেষক বঙ্গোপসাগর থেকে আহরিত লইট্টা মাছের পেটে খাবারের সঙ্গে প্লাস্টিক কণা পেয়েছেন। ক্ষতিকর এই বস্তুটি সামুদ্রিক মাছ সার্ডিন ও চিংড়ির দেহেও পাওয়া গেছে। এমনকি সামুদ্রিক সবুজ শামুক ও কাঁকড়ার পাকস্থলীতেও প্লাস্টিক কণা পেয়েছে গবেষক দলটি।
দেশে শুঁটকির চাহিদা অনেক। বিশেষ করে লইট্টা শুঁটকির চাহিদা সবচেয়ে বেশি। কক্সবাজার উপকূলে বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার শুঁটকি উৎপাদিত হয়। আর এর এক-তৃতীয়াংশই হচ্ছে লইট্টা শুঁটকি। গবেষক দলের তথ্যানুযায়ী, যেসব প্রাণীর দেহে প্লাস্টিক কণার উপস্থিতি নিয়ে গবেষণা হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক বার্তা দিচ্ছে লইট্টা। বর্তমানে লইট্টা মাছের ভরা মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। বঙ্গোপসাগর থেকে জেলেরা লইট্টা আহরণ করছেন। যার বেশির ভাগই যাচ্ছে শুঁটকি প্রক্রিয়াজাত কারখানায়। আর এই মাছ শুঁটকি করার সময় এর পাকস্থলী ও পরিপাকতন্ত্র কেটে ফেলা হয় না। যার কারণে প্লাস্টিক কণাসহ সেটি শুঁটকিতে পরিণত হয়। আর পরবর্তীতে তা খাবারের সঙ্গে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে।
চলতি বছরের শুরুতে ‘সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট’ নামক সাময়িকীতে লইট্টা ও সার্ডিনের ওপর করা গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে আর চিংড়ির ওপর করা গবেষণাটি ‘ক্যামোস্ফেয়ার’ নামের আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। বাকি আরও দুটি গবেষণা প্রকাশের অপেক্ষায় আছে। প্রকাশিত ওই দুই গবেষণায় বলা হযেছে যে, উত্তর বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন স্থান থেকে লইট্টা, চিংড়ি ও সার্ডিনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। প্রায় ৩০০ মাছের নমুনা সংগ্রহ করে সেগুলো কেটে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস ও পরিবেশ অধিদপ্তরের পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা হয়। সবগুলোতে পাওয়া যায় প্লাস্টিক কণা।
গবেষণায় ৬ ধরনের প্লাস্টিক কণা গবেষণায় মূলত ছয় ধরনের প্লাস্টিক কণা পাওয়া গেছে। এগুলোর উৎস খুঁজতে গিয়ে গবেষক দলটি দেখেছে মূলত পলিয়েস্টারের তৈরি মাছ ধরার জাল, কর্কশিট, খাবারের প্যাকেট ও পলিথিন, পানির বোতল ও আসবাব থেকে ওই প্লাস্টিক কণা এসেছে। সেগুলো নদী থেকে সাগরে গিয়ে পড়েছে। ঢেউয়ের তোড়ে সেগুলো ভেঙে ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হচ্ছে। মিশে যাচ্ছে প্রাণী ও উদ্ভিদকণার সঙ্গে। আর মাছ ও সামুদ্রিক প্রাণী তা খেয়ে নিচ্ছে খাদ্য ভেবে।প্লাস্টিক কণা খাওয়ার কারণে মাছের শরীরে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। কমে যায় মাছের হজমশক্তি। ব্যাহত হয় বৃদ্ধি। গবেষক দলটি এখন বঙ্গোপসাগরের অন্য বড় মাছে প্লাস্টিকের উপস্থিতি আছে কি না, তা নিয়ে কাজ করছে।
গবেষক দলের সদস্য ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেসের অধ্যাপক মো. শাহাদাত হোসেন এ সম্পর্কে বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্লাস্টিক কণাকে আগামী দিনের জন্য অন্যতম ক্ষতিকারক উপাদান হিসেবে দেখা হচ্ছে। প্লাস্টিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের আরও সাবধান হতে হবে। কারণ এটি ঘুরেফিরে আমাদের দেহে প্রবেশ করছে।’
গবেষক দলের আরেক সদস্য ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সুব্রত সরকার বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরের ছোট মাছে এই ক্ষতিকর উপাদান পাওয়ার ফলে আমাদের মনে হচ্ছে এখানকার অন্য সব প্রাণীর শরীরেও তা থাকতে পারে। সেগুলো অনেকাংশই আমরা খাচ্ছি, রপ্তানি করছি। তাই সবার আগে নদী ও সমুদ্রে প্লাস্টিক ফেলা বন্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারকে কঠোর হতে হবে।’
গবেষক দলটি জানিয়েছে, প্লাস্টিক কণা মাছসহ অন্যান্য জৈব উপাদানের মধ্যেও পাওয়া যাচ্ছে, যা জাপান, নরওয়ে, সুইডেন, মেক্সিকোসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশের উপকূল থেকে আহরিত মাছে মাত্রাতিরিক্ত পাওয়া গেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এত দিন এ বিষয়ে কোনো গবেষণা ছিল না। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একাধিক গবেষণা শুরু হলেও শেষ হয়নি।
ক্ষতিকর প্লাস্টিক কণা নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ কে এম রফিক আহাম্মদ বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে দেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা নানা উদ্যোগ নিয়েছি। পণ্যের মোড়কসহ নানা কাজে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের সামগ্রী যাতে যত্রতত্র ফেলা না হয় এবং তা সংগ্রহ করে যাতে পুনর্ব্যবহার করা যায়, সে ব্যাপারে কাজ করছি। এসব পণ্যের উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ কাজে আমাদের সহযোগিতার পরামর্শ দিচ্ছি।’
সরকারের সামুদ্রিক মৎস্য জরিপ ব্যবস্থাপনা ইউনিটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. শরিফ উদ্দিন বলেন, ‘আমরা সামুদ্রিক মাছের পরিমাণ ও ধরন নিয়ে জরিপ করছি। তাই সেখানকার মাছের মধ্যে যাতে ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য আমাদের আগে থেকে সাবধান হতে হবে। জেলেরা যাতে নৌকায় করে প্লাস্টিক সামগ্রী না নেয়, জাহাজ থেকে প্লাস্টিক সামগ্রী সাগরে ফেলা না হয়, সে জন্য সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বশীল হতে হবে।’ সূত্র: প্রথম আলো