মহাবিপন্ন প্রাণী রক্ষায় গবেষণা চলছে করমজলে
কচ্ছপের প্রজাতিটি পৃথিবী থেকে হারিয়ে যেতে বসেছিল। খুঁজে পেতে কয়েকটি কচ্ছপ এনে ছেড়ে দেওয়া হয় সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের করমজল বন্য প্রাণী প্রজননকেন্দ্রে। কয়েক বছরের ব্যবধানে ছানাপোনা নিয়ে তাদের সংখ্যা এখন কয়েক’শ। গবেষণা চলছে কচ্ছপগুলো নিয়ে। পিঠে যুক্ত করা হয়েছে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার।
যে কচ্ছপ নিয়ে এত কথা, তার নাম বাটাগুর বাসকা। মহাবিপন্ন এই প্রাণীটিকে রক্ষায় এন্তার গবেষণা চলছে সুন্দরবনের করমজলে। আর কচ্ছপগুলোর দেখভাল ও লালনপালন করছে বন বিভাগ।
একসময় দেশের বেশির ভাগ জলাশয় ঘিরে ছিল কচ্ছপের আনাগোনা। কেবল নদী, খাল, বিলের মতো মুক্ত জলাশয়ই নয়, বিভিন্ন প্রজাতির কচ্ছপের দেখা মিলত গ্রামের পুকুর-দিঘিতেও।
এখন গ্রামের জলাশয় বা নদীপাড়ে কচ্ছপের দেখা পাওয়া যায় কালেভদ্রে। বন বিভাগ ও প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএনের হিসাবে, বাংলাদেশে মোট ৩০ প্রজাতির কচ্ছপ পাওয়া যেত।
প্রজাতি সংখ্যার দিক দিয়ে বেশি হলেও বাংলাদেশে এর অনেকগুলোই এখন বিলুপ্তির পথে। যার মধ্যে ২২ প্রজাতির কচ্ছপ বাংলাদেশে তো বটেই, বিশ্বজুড়ে বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত।
তেমনই এক মহাবিপন্ন প্রজাতির কচ্ছপ বাটাগুর বাসকা। ২০০০ সাল থেকে গবেষকেরা ধারণা করেন, পৃথিবীতে বাটাগুর বাসকা প্রজাতির কচ্ছপের আর অস্তিত্ব নেই।
বিষয়টি নিশ্চিত হতে ২০০৮ সালে প্রকৃতিতে বাটাগুর বাসকা আছে কি না, তা খুঁজতে শুরু করেন গবেষকেরা। পরে নোয়াখালী ও বরিশাল অঞ্চলের বিভিন্ন জলাশয়ে আটটি বাটাগুর বাসকা পাওয়া যায়। যার মধ্যে চারটি পুরুষ ও চারটি স্ত্রী কচ্ছপ ছিল।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ বলছে, প্রকৃতিতে নতুন করে আবারও বাটাগুর বাসকা কচ্ছপ পাওয়ার পর এগুলোকে সংরক্ষণ ও প্রজননের জন্য নেওয়া হয় গাজীপুরে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে। বন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা সেগুলোকে নিবিড়ভাবে লালনপালন ও প্রজননের চেষ্টা করেন।
তবে ঈষৎ লবণপানির এই কচ্ছপগুলো সেখানকার পরিবেশের সঙ্গে সেভাবে খাপ খাওয়াতে পারেনি। ২০১৪ সালে মূল আটটি বাটাগুর বাসকা এবং তাদের জন্ম দেওয়া ৯৪টি বাচ্চাসহ সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের করমজল বন্য প্রাণী প্রজননকেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়।
সে সময় চাঁদপাই রেঞ্জ কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন এখন সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও)। তিনি বলেন, ‘বাটাগুর বাসকা সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় করমজলে ওই কচ্ছপগুলো আনা হয়। প্রথমে যখন এগুলো আনা হলো, আমাদের মধ্যেও সংশয় ছিল। প্রাণীগুলো আমরা রক্ষা করতে পারব তো? তবে ২০১৭ সালে করমজলে এসে যখন প্রথম এই কচ্ছপগুলো ডিম দেয়, বাচ্চা ফোটে, আমরাও আশাবাদী হই।’
বন বিভাগ বলছে, বিলুপ্ত প্রজাতির এই কচ্ছপগুলোর সম্পর্কে বিস্তারিত সব তথ্য ছিল না তাদের কাছেও। তাই প্রজাতিটি রক্ষায় এদের জীবনাচার, খাদ্যাভ্যাস, জীবনকাল, গতিপ্রকৃতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে জানতে গবেষণার দরকার ছিল। করমজলে এসব নিয়েই কাজ শুরু হয়।
মূলত এই গবেষণা প্রকল্পের আওতায় দেশি–বিদেশি মিলিয়ে মোট চারটি সংস্থা কাজ করছে। এগুলো হলো বাংলাদেশের বন বিভাগ, প্রকৃতি ও জীবন, অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা চিড়িয়াখানার গবেষণা দল ‘জু ভিয়েনা’ এবং যুক্তরাষ্ট্রের কচ্ছপ সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থা ‘টার্টল সার্ভাইভাল অ্যালায়েন্স’, যা কিনা প্রাণী সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান।
করমজল প্রজননকেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা বন বিভাগের কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, ‘এই কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রকৃতিতে হারাতে বসা এই মহাবিপন্ন কচ্ছপটিকে আবারও ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করছি আমরা। আমরা নানাভাবে বাটাগুর বাসকা কচ্ছপ সম্পর্কে তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ করছি।
এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে পিঠে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার যুক্ত করে এই প্রজাতির ২২টি কচ্ছপ আমরা বিভিন্ন নদ-নদী ও সাগর মোহনায় অবমুক্ত করি। এ থেকে এই কচ্ছপের জীবনাচরণ, কী ধরনের প্রকৃতি তারা পছন্দ করে—নানা ধরনের তথ্য আমরা পেয়েছি। করমজলে এর ডেটা সেন্টার। সেখানে এখন পর্যন্ত এই প্রজাতির জন্ম নেওয়া সব কচ্ছপের তথ্য রয়েছে।’
হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, একসময় সুন্দরবনে এই প্রজাতির কচ্ছপ ছিল। শিকার, প্রাকৃতিক পরিবেশসহ নানা কারণে এখন বনে আর এর অস্তিত্ব নেই। বনের পুকুরগুলোতে ছাড়া এই কচ্ছপগুলো একদম উন্মুক্ত থাকবে। সম্প্রতি ৪০টি এবং এর আগে বিভিন্ন সময় ২২টি বাটাগুর বাসকা কচ্ছপ উন্মুক্তের পর করমজল কেন্দ্রে ৩৮৪টি কচ্ছপ আছে।
বন বিভাগ বলছে, এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রাথমিকভাবে তাদের ধারণা, মহাবিপন্ন প্রজাতির বাটাগুর বাসকা কচ্ছপ ১৭-১৮ বছর বয়সে প্রাপ্তবয়স্ক হয়, আয়ুষ্কাল ৪০-৬০ বছর।
আবদুর রব বলেন, করমজলে প্রতিটি কচ্ছপের শরীরেই একটি মাইক্রচিপ লাগানো আছে। এদের প্রতিটির বিস্তারিত সব তথ্য আছে। তাদের ১৫ ডিজিটের একটি ইউনিক আইডি নম্বর আছে। বনের পুকুরে ছাড়া কচ্ছপগুলো ৮ মাস পরে তাঁরা তুলে দেখবেন, সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশে এরা কেমন আছে।
এগুলো (ওজন) বাড়ল না কমল। যদি দেখা যায়, এখানে সবকিছু ভালো, তবে পর্যায়ক্রমে সুন্দরবনের সব পুকুরেই তাঁরা এই কচ্ছপ ছাড়বেন। এসব পুকুর থেকেই প্রাকৃতিকভাবে বংশবিস্তার করে সাগর-নদীতে চলে যাবে এই প্রজাতির কচ্ছপ।