মহান আল্লাহ বৃষ্টি বর্ষণের মাধ্যমে এ পৃথিবীকে জীবন্ত রাখেন এবং সকল জীবের বাসযোগ্য পরিবেশ সংরক্ষণ করেন
মো. মিকাইল আহমেদ (Md. Mekail Ahmed)
শিক্ষার্থী, আইইসিএমএবি, ঢাকা।
অন্যান্য গ্রহের তুলনায় পৃথিবীর আকার ছোট হলেও বৈচিত্র্যময়। পৃথিবীর সর্বত্রই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অপার বিস্ময়। বরফে ঢাকা এন্টার্কটিকা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে মানব শূন্য ও বৃক্ষশূন্য গরম উত্তপ্ত বালুকাময় সাহারা মরুভূমি। পৃথিবীর এক প্রান্তে বিস্তীর্ণ জলরাশি থাকলেও অন্য প্রান্তে রয়েছে পানির জন্য তীব্র হাহাকার।
পৃথিবীর মোট আয়তনের চার ভাগের তিন ভাগ পানি। তারপরও মানুষ গাছপালা প্রাণীকুল বৃষ্টির পানির উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। অতএব বলা যায় বৃষ্টির পানি পৃথিবীবাসীর জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। নির্জীব পৃথিবীকে তিনি সজীব করেন, আবার তিনিই সজীব স্থানকে মরুভূমিতেও পরিণত করতে পারে।
পানির অপর নাম জীবন। উদ্ভিদ, প্রাণিকুল কিংবা মানুষ, পানি ছাড়া কোন জীবই বেঁচে থাকা অসম্ভব। পানির মাধ্যমে সব বস্তুকে আল্লাহ সজীব রাখেন। পানি ছাড়া কোন প্রাণ জীবন্ত থাকতে পারে না।
শীতল হয় না তৃষিত মন। এরশাদ হচ্ছে, ‘আমি আকাশ থেকে পবিত্রতা অর্জনের জন্য পানি বর্ষণ করি; তা দ্বারা মৃত ভূ-ভাগকে সঞ্জীবিত করে তুলি। আমার সৃষ্ট জীবজন্তু ও অনেক মানুষের তৃষ্ণা নিবারণ করাই।
আর আমি তা তাদের মধ্যে বিভিন্নভাবে বিতরণ করে থাকি; যাতে তারা স্মরণ করে। কিন্তু অধিকাংশ লোক অকৃতজ্ঞতা ছাড়া কিছুই করে না।’ (সূরা ফোরকান, আয়াতঃ ৪৮–৫০)।
আল্লাহ কুরআনে বর্ণনা করেছেনঃ
”তিনি আল্লাহ, যিনি বায়ু প্রেরণ করেন, অতঃপর তা মেঘমালাকে সঞ্চারিত করে। অতঃপর তিনি মেঘমালাকে যেভাবে ইচ্ছা আকাশে ছড়িয়ে দেন এবং তাকে স্তরে স্তরে রাখেন।
এরপর তুমি দেখতে পাও তার মধ্য থেকে নির্গত হয় বৃষ্টিধারা। তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাদেরকে ইচ্ছা পৌঁছান; তখন তারা আনন্দিত হয়। (সূরা আর-রুম: আয়াত ৪৮)
বৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা
বৃষ্টির অভাবে ফসলের খেত ফেটে চৌচির হয়ে যায়। বিপাকে পড়েন কৃষকেরা। সবুজ-শ্যামল প্রকৃতি বৃষ্টির ফল। বৃষ্টি বা পানির স্পর্শ ছাড়া ফসল পরিপক্ক হয় না। এরশাদ হচ্ছে, ‘আমি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করি।
অতঃপর তা দ্বারা সর্বপ্রকার উদ্ভিদ উৎপন্ন করি। এরপর এ থেকে সবুজ ফসল নির্গত করেছি, যা থেকে যুগ্ম বীজ উৎপন্ন করি। খেজুরের কাদি থেকে গুচ্ছ বের করি; যা নুয়ে থাকে। আর আঙ্গুরের বাগান, জয়তুন, আনার পরস্পর সাদৃশ্যযুক্ত এবং সাদৃশ্যহীন।
বিভিন্ন গাছের ফলের প্রতি লক্ষ্য করো, যখন সেগুলো ফলন্ত হয় এবং তার পরিপক্কতার প্রতি লক্ষ্য করো। নিশ্চয়ই ইমানদারদের জন্য এগুলোতে নিদর্শন রয়েছে।’ (সূরাঃ আনআম, আয়াতঃ ৯৯)।
গরমে বৃষ্টি হয় আরামের। প্রচন্ড গরমের দাবদাহে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে মানুষ ও প্রকৃতি। আল্লাহর দরবারে একটু বৃষ্টির জন্য ব্যাকুল হয়ে যায় সকলে।
তখনই আল্লাহর নির্দেশে পরম শান্তির পরশ নিয়ে হাজির হয় কাঙ্খিত বৃষ্টি। অবিরাম বৃষ্টির ধারায় মানব মনে আনে প্রশান্তি। বৃষ্টির কল্যাণে প্রকৃতি সতেজ ও নির্মল হয়ে ওঠে। প্রাণ বাঁচে প্রাণীকূলের।
বর্তমানে ভয়ঙ্কর অবস্থা ফ্রান্স, স্পেন ও পর্তুগালে। দাবানল সমানে ছড়াচ্ছে। হাজার হাজার হেক্টর জমির বনভূমি পুড়ে ছাই। প্রচুর মানুষকে সরানো হয়েছে নিরাপদ আশ্রয়ে। জ্বলছে ফ্রান্স।
দক্ষিণ ফ্রান্সের বিস্তৃত এলাকা জ্বলছে। দাবানল গ্রাস করছে বনভূমি, ঘরবাড়ি ও ফসলি মাঠ। ইউরোপে এবার অস্বাভাবিক গরম পড়েছে। ফ্রান্সে তাপমাত্রা আরো বাড়তে পারে।
দক্ষিণ ফ্রান্সে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। আর এই গরম হলো একেবারে শুকনো গরম। তার ফলেই দাবানল ছড়াচ্ছে। [1]
পবিত্র কোরআনে বৃষ্টি, বৃষ্টির কারণ, বৃষ্টির দান, বৃষ্টির শিক্ষা ও বৃষ্টির স্রষ্টার কথা বারবার তুলে ধরা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহ আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন এবং তা দিয়ে তিনি ভূমিকে তার মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত করেন।
নিশ্চয়ই এতে নিদর্শন রয়েছে এমন সম্প্রদায়ের জন্য, যারা কথা শোনে।’ (সূরাঃ নাহল, আয়াত: ৬৫)।
আবু দাউদের বর্ণনায় এসেছে, মহানবী (সা.) বলেছেন, বৃষ্টির সময় করা দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না।’ পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘আর আল্লাহ আকাশ থেকে পানি অবতীর্ণ করেছেন এবং পৃথিবীকে এর মৃত্যুর পর এর মাধ্যমে জীবিত করে তুলেছেন। নিশ্চয় এতে সেইসব লোকের জন্য রয়েছে এক বড় নিদর্শন যারা কথা শুনে’ (সুরাঃ নাহল, আয়াতঃ ৬৫)।
রৌদ্রজ্জ্বল তাপদাহে তপ্ত ধরণী হয় অতিষ্ট। একটু বৃষ্টির জন্য পৃথিবীবাসীর হাহাকার বেড়ে যায়। প্রাণ হয়ে যায় ওষ্ঠাগত। তখনই আল্লাহপাকের অপার মহিমায় বারিধারা হয়ে উঠে সুজলা-সুফলা।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তুমি পৃথিবীকে নিষ্প্রাণ দেখতে পাও। এরপর আমি যখন এর ওপর পানি বর্ষণ করি তখন তা সক্রিয় হয়ে ওঠে ও ফেঁপে ফুলে ওঠে এবং প্রত্যেক প্রকার উদ্ভিদের সবুজ শ্যামল শোভামণ্ডিত জোড়া উৎপন্ন করে’ (সুরাঃ হজ, আয়াত: ৫)।
আল্লাহতায়ালা আরো বলেন- ‘তুমি কি দেখনি, নিশ্চয় আল্লাহ আকাশ থেকে পানি অবতীর্ণ করেন যার ফলে পৃথিবী সবুজশ্যামল হয়ে ওঠে? নিশ্চয় আল্লাহ অতি সূক্ষদর্শী ও সর্বজ্ঞ’ (সুরাঃ হজ, আয়াতঃ৬৩)।
ওয়াটার এইড বাংলাদেশ কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিন জাহান বলেন, “ভূগর্ভস্থ পানি ক্রমশঃহ্রাস পাওয়ার কারনে আসন্ন দিনগুলোতে যে পানি সংকটের মুখে বাংলাদেশ পড়তে যাচ্ছি, তা সমাধানে আমাদের সবাইকে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে গ্রহন করতে হবে।
প্রশস্ত স্থান সহকারে উন্মুক্ত ছাদ একটি টেকসই সমাধান হতে পারে এবং ব্যবসায় বিশেষ করে শিল্পে ক্রমবর্ধমান পানির চাহিদা মেটানোর উত্তম উৎস হতে পারে।
সকল খাতগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টায় বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে শিল্পে পানির চাহিদা পূরণ এবং জল-সম্পদের সাশ্রয়ী ব্যবহার নিশ্চিত করা যেতে পারে।”
সাম্প্রতিক সময়ে, বাংলাদেশের পোশাক ও বস্ত্র কারখানাগুলো রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম চালু করে সবুজনীতি বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং টেকসই পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান উদ্যোগগুলো পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব কমিয়ে ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করছে। [2]
সমগ্র বিশ্বে জৈব জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং শিল্পকারখানা থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2) নির্গমণের কারণে বাতাসে এ গ্যাসের মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে এসব CO2 সূর্যের বিকিরিত তাপের একটা অংশ আটকে রেখে বৈষ্ণয়িক উষ্ণায়নে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
বিজ্ঞানীরা ৮টি শীর্ষ কার্বন নির্গমনকারী খাত চিহ্নিত করেছেন, যেমন- বিদ্যুৎ কেন্দ্র- ২১.৩%, শিল্প-কারখানা- ১৬.৮%, পরিবহন- ১৪%, কৃষি উপজাত- ১২.৫%, জীবাশ্ম জ্বালানি উত্তোলন প্রক্রিয়াজাত ও বিপণন- ১১.৩%, আবাসিক ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম- ১০.৩%, ভূমি ব্যবহার ও জৈব জ্বালানি- ১০% এবং বর্জ্য নিষ্কাশন ও পরিশোধন- ৩.৪%।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি CO2 নির্গমনকারী দেশগুলো হচ্ছে চীন, আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল, ভারত, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছু দেশ। চীন ও আমেরিকার কার্বন নির্গমনের পরিমাণ মোট নির্গমনের প্রায় ৫০ শতাংশ। [3]
কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য ইউরোপের বিভিন্ন শহরে আবহাওয়ার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কঠোরভাবে। পরিবেশের অবস্থা বদলানোর জন্য এরই মধ্যে আমস্টারডাম নানা উদ্যোগ নিয়েছে। ২০৫০ সাল নাগাদ প্রথম ইউরোপিয়ান শহর হিসেবে জিরো কার্বন-ডাই অক্সাইড নিঃসরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে এই শহর।
আর এজন্য প্রথম ও উল্লেখযোগ্যভাবে নজর দেওয়া হচ্ছে পাবলিক ও প্রাইভেট ট্রান্সপোর্টেশনে। শহরের সব ডিজেল বাস বদলে ফেলা হচ্ছে, বাড়ানো হচ্ছে ইলেকট্রিক ট্যাক্সির সংখ্যা। জনগণ যেন নিজেদের ব্যক্তিগত গাড়িকে ইলেকট্রিক্যাল করে ফেলতে পারে সেজন্য অর্থও দেওয়া হচ্ছে।
যেসব গাড়ির কারণে পরিবেশ বেশি দূষিত হচ্ছে সেগুলো শহর থেকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। যদি এ কাজে তারা সফল হতে পারে, তবে আমস্টারডাম হতে যাচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম সবুজ শহরের একটি। [4]
পৃথিবীর তপ্ত দেহকে বিশুদ্ধ করার উপকরণ বৃষ্টি। বৃষ্টি আল্লাহর পক্ষ থেকে বর্ষিত হয় অবারিত রহমত হিসেবে। পৃথিবীকে পবিত্র করার উপঢৌকন বৃষ্টি। পৃথিবীর দেহকে ধুয়ে-মুছে বিশুদ্ধ করে বৃষ্টি।
বৃষ্টির শীতল ছোঁয়ায় এ বসুন্ধরা সজীব-পবিত্র হয়। পরিবেশের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার হয়। এরশাদ হচ্ছে, ‘তুমি কি দেখনি, আল্লাহ আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন। অতঃপর সে পানি জমিনে ঝরনাসমূহে প্রবাহিত করেছেন।
এরপর তা দ্বারা বিভিন্ন রঙের ফসল উৎপন্ন করেন। অতঃপর তা শুকিয়ে যায়। ফলে তোমরা তা পীতবর্ণ দেখতে পাও। এরপর আল্লাহ সেগুলি খড়কুটায় পরিণত করে দেন। নিশ্চয়ই এতে বুদ্ধিমানদের জন্য উপদেশ রয়েছে।’ (সূরাঃ যুমার, আয়াত:২১)।
মহান আল্লাহ এরশাদ করেন, “তিনি পৃথিবীকে তাঁর সৃষ্ট জীবের জন্য স্তাপন করেছেন (সৃষ্টি করেছেন) (সূরাঃ আর রাহমান, আয়াত:১০)।
সুতরাং বিজ্ঞানীরা মঙ্গল গ্রহ, শুক্র গ্রহ কিংবা অন্য যে কোন গ্রহে মানুষের বসবাসের জন্য যত চেষ্টাই করে থাকুন না কেন পৃথিবী ব্যতীত কোণায়ও জীবন টিকবে না। তাই আমাদের উচিত মহান আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত সকল জীবের জন্য বাসযোগ্য এ পুথিবীকে দূষণমুক্ত রেখে সকল জীবের বাসযোগ্য পরিবেশ অক্ষুন্ন রাখা।
Reference
- [1] দাবানলের গ্রাসে ইউরোপ, জ্বলছে ফ্রান্স-স্পেন-পর্তুগাল, ডয়চে ভেলে
- [2] https://www.bvnews24.com/economy/news/58301
- [3] http://www.ais.gov.bd/site/view/krishi_kotha_details
- [4] বিশ্বের সবুজ চার শহর https://www.deshrupantor.com/home/printnews/292161/2021-05-10.