ময়লা আবর্জনায় আবারও আগের চেহারায় ঢাকার খাল
বছর না পেরোতেই আবারও পুরনো চেহারায় ফিরে গেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের খালগুলো। ময়লা আবর্জনার স্তূপে একেবারে বিবর্ণ রূপ ধারণ করেছে।
জলাবদ্ধতা নিরসনে বিশাল ভূমিকা রাখার কথা এই খালগুলোর, কিন্তু আবর্জনা জমে সেখানে স্বাভাবিক পানিপ্রবাহই বন্ধ। যার ফলে বর্ষা শুরুর আগে হালকা বৃষ্টিতেই পানি জমে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত বছরের জুলাইয়ের শেষ দিকে করপোরেশনের আওতাধীন কাজলা খাল, মাতুয়াইল কবরস্থান খাল, মৃধা বাড়ি খাল, শ্যামপুর খালের ২৪ ফুট রাস্তার সম্মুখ প্রান্ত থেকে মোহাম্মদী ব্রিজ পর্যন্ত পরিষ্কার করা হয়।
শ্যামপুর খালের ২৪ ফুট রাস্তার সামনের প্রান্ত থেকে বটতলা পর্যন্ত, শাজাহানপুর ঝিল থেকে বাসাবো কদমতলা শুকনগর খাল, মান্ডা খালের শুকনগর থেকে শাপলা ব্রিজ হয়ে আমিন মোহাম্মদ ব্রিজ পর্যন্ত, স্টাফ কোয়ার্টার থেকে ডগাইর সাংবাদিক বাড়ি খাল, সুখনগর-নন্দীপাড়া-ত্রিমোহনী (জিরানি) খালে এবং জিয়া সরণি খালে বিশেষভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম চালানো হয়। কিন্তু বছর না পেরোতেই আবারও মানুষের ফেলা ময়লা-আবর্জনায় পরিপূর্ণ হয়ে গেছে খালগুলো।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯টি খালের সবকটিতেই কমবেশি আবর্জনার স্তূপ জমে আছে। গৃহস্থালির বর্জ্য থেকে শুরু করে দোকানপাটের বর্জ্য সবকিছু স্থান পেয়েছে এসব খালে।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৬৩ নম্বর ওয়ার্ডের দিকে এগিয়ে যেতেই পথে পড়ে কাজলা খাল। ময়লার স্তূপের কারণে এই খালে পানি প্রবাহ বন্ধ। সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে রাজধানীতে হওয়া বৃষ্টির কারণে এই এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ঘূর্ণিঝড়ের এক সপ্তাহ পরেও জলমগ্ন ছিল এলাকাটি। কারণ এখানে পানি প্রবাহের স্বাভাবিক পথ নেই।
পলিথিন, প্লাস্টিক, ভাঙা চেয়ার, ছেঁড়া কাপড়, তোষক, বাঁশের চাটাই কী ভাসছে না ওই খালে। মাতুয়াইল ও মৃধা বাড়ি খালেরও একই অবস্থা। এই খালের পাড় দিয়ে যাওয়ার সময় মানুষ ময়লার গন্ধে নাক চেপে ধরতে হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা হাবিব জানান, বাসা বাড়ির পয়োবর্জ্য সরাসরি এসে খালের পানিতে পড়ে। ময়লার স্তূপ জমে থাকায় খালের পানি প্রবাহ বন্ধ। যার জন্য পয়োবর্জ্য আর ইউরিনের গন্ধে মানুষকে এখান দিয়ে হাঁটার সময় নাক চেপে হাঁটতে হয়।
বাসাবো কদমতলা শুকনগর খালের অবস্থাও শোচনীয়। দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা পানিতে মরা কুকুর, পলিথিন-প্লাস্টিকে একেবারে বাজে অবস্থা সেই খালের। সেখানকার বাসিন্দা মনিরুল জানান, কয়দিন আগে এখানে গাড়ি এক্সিডেন্টে একটা কুকুর মারা গেছে।
দুদিন ধরে পড়ে ছিল, সিটি করপোরেশনের লোকেরা নেয় নাই। পরে এখানকার কয়েকজন কোনোরকমে খালের মধ্যে ঠেলে ফেলে দিছে। খালে পানিতে স্রোত না থাকায় ওটা ওখানেই পড়ে আছে। এজন্য চারপাশে গন্ধ ছড়াচ্ছে।
শ্যামপুর খাল ও নন্দীপাড়ার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া জিরানি খাল দেখে বোঝার উপায় নেই এই দুটো খাল নাকি ময়লার ভাগাড়। দূর থেকে মান্ডা খাল দেখতে একটা সবুজ মাঠের মতো।
অবশ্য শ্যামপুর, জিরানি, মান্ডা ও কালুনগর খাল পুনরুদ্ধারের কাজ ইতোমধ্যেই শুরু করেছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। তবে সঠিক সময়ে এই কাজ শেষ করতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে।
নন্দীপাড়ার বাসিন্দা রহমান বলেন, শুনেছি খাল সংস্কার আর দখলমুক্ত করার অভিযান শুরু করেছে সিটি করপোরেশন। কিন্তু এদিকে এখনও কোনও কাজ করতে দেখিনি। খাল দখলমুক্ত করতে পারবে কিনা এ নিয়ে সংশয়ে আছি।
খাল বা পানি প্রবাহের মধ্যে সাধারণ মানুষ যেন কোনও ধরনের ময়লা আবর্জনা না ফেলে সেজন্য তাদের মাঝে সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ।
তিনি বলেন, জনগণকে সচেতন করার নানান উপায় আছে। যদি তাতেও কাজ না হয় তাহলে প্রয়োজনে শাস্তি বা জরিমানার ব্যবস্থা করে হলেও সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। এতে করে তারা নিজেরাই সুফল ভোগ করতে পারবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শক মো. সেলিম মৃধা বলেন, পাবলিকের ফেলা ময়লা এবং সুয়ারেজ লাইন থেকে আসা ময়লা জট বেঁধে আছে।
আমরা কিন্তু বারবার নিষেধ করি। এরপরও কেউ আমাদের কথা শুনছে না। সুয়ারেজ লাইনে বা খালে ময়লা না ফেলতে আমরা মাইকিং করে নিষেধ করেছি। তবুও কেউ আমাদের কথায় কর্ণপাত করেনি।
কাজলা খালে ময়লা আবর্জনা ফেলার বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৬৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. শফিকুল ইসলাম খান বলেন, সিটি করপোরেশন থেকে প্রত্যেক ঘরে ঘরে ময়লার জন্য লোক যায়। কিন্তু এখানকার বাসিন্দারা মাত্র ১০০ টাকা ময়লার বিল না দেওয়ার জন্য তাদের বাসা বাড়ির ময়লাগুলো খালের মধ্যে ফেলে।
আমরা তাদের বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তারা আমাদের কথা শোনে না। সিটি করপোরেশন থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে খাল পরিষ্কার রাখার জন্য। কিন্তু জনগণ যদি সহযোগিতা না করে তাহলে তো সম্ভব না।
ডিএসসিসি মেয়র নিজে এসে এখানকার বাসিন্দাদের খালে ময়লা আবর্জনা না ফেলতে অনুরোধ করেছেন। কিন্তু কেউ কথা শুনেনি। এখনও দেদার ময়লা ফেলছে। তার ফল অবশ্য ভোগ করছে। ঝড়-বৃষ্টির এক সপ্তাহ পরেও এখানে জলাবদ্ধতা থাকছে।
এদিকে গতবছর কিছু অংশে বর্জ্য অপসারণ করা শ্যামপুর ও জিরানি খালসহ মান্ডা এবং কালুনগর খালের নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ৮৯৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এর মধ্যে ৮ দশমিক ৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মান্ডা খালের জন্য ব্যয় হবে ৩৯৭ কোটি টাকা।
আগামী বছরের জুনের মধ্যে এই চারটি খাল পুনরুদ্ধার করে আধুনিকায়ন করা হবে বলে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস।