চীনে বুবোনিক প্লেগের আর্বিভাব – যা ১৪ শত শতাব্দিতে বিশ্বে ৭.৫ হতে ২০ কোটি লোককে হত্যা করেছিল
চীনের অভ্যন্তরীন স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল মঙ্গোলিয়ার বায়ানুর শহরে সম্প্রতি বুবোনিক প্লেগে দুই ব্যক্তি আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছে। ফলে ঐ অঞ্চলে তিন স্তরের উচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
রাষ্ট্র পরিচালিত বার্তা সংস্থা সিনহুয়া জানিয়েছে, বেইজিংয়ের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত বায়ানুর শহরে এই রোগটি প্রথমে চিহ্নিত করা হয়েছে। ৫ জুলাই, ২০২০ তারিখে একটি হাসপাতালে সন্দেহভাজন রোগটি সনাক্ত হওয়ার পর পৌর কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করা হয়েছে।

সিংহুয়া জানিয়েছে, আশেপাশের পাঁচটি তৃণভূমির প্রাকৃতিক দৃশ্য পরিদর্শণ বন্ধ করা হয়েছে, দর্শনার্থীদের “ক্ষতিগ্রস্থ অঞ্চলে প্রবেশ করা এবং আশেপাশের অঞ্চলে পরিদর্শন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।” সিনহুয়ার খবর অনুসারে, সতর্কতাটি বছরের শেষ অবধি থাকবে।
সিনহুয়া জানিয়েছে, ডাক্তাররা রোগটি এক ব্যক্তির দেহে সনাক্তের পর রোগীকে আলাদা করে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে এবং তার অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে।
মঙ্গোলিয়ায় রাশিয়ান দূতাবাস বলেছে যে “গুরুতর উদ্বেগের কোনও কারণ নেই” মঙ্গোলিয়ান কর্তৃপক্ষ ভ্রমণ বিধিনিষেধ আরোপ করেছে এবং সংক্রামিত ব্যক্তিদের বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে বলে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আরআইএ নভোস্টি জানিয়েছেন।
আরআইএ নোভোস্টি দূতাবাসটির উদ্ধৃতি দিয়ে আরও জানিয়েছে যে, মঙ্গোলিয়ায় বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) প্রতিনিধি সের্গেই ডিওর্ডিটসুরও বলেছেন যে, প্রদেশটি এই মৌসুমের প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখছে।
বুবোনিক প্লেগ কি?
“ইয়ারসিনিয়া পেস্টিস” নামক ব্যাকটিরিয়া সংক্রমণের কারণে সৃষ্ট বুবোনিক প্লেগ মানব ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক মহামারী ছিল। ইহাকে ব্ল্যাক ডেথ ও বলা হয়ে থাকে। কারণ, এই রোগ হলে রোগীর ত্বক কালো বর্ণ ধারণ করে।
ব্ল্যাক ডেথ ১৪ শতকে আফ্রিকা, এশিয়া এবং ইউরোপ জুড়ে প্রায় ৭.৫০ কোটি হতে ২০ কোটি মানুষকে হত্যা করেছিল। এর পরও মাঝে মাঝে কিছু সময়ের জন্য এর বড় আকারের প্রকোপ দেখা দিয়েছে।
এটি ১৬৬৫ সালের মহামারী চলাকালীন সময়ে লন্ডনের জনসংখ্যার প্রায় এক পঞ্চমাংশকে হত্যা করেছিল এবং চীন ও ভারত বর্ষে ১৯ শতকের সময়ে ১.২০ কোটিরও বেশি লোক মারা গিয়েছিল।
ব্ল্যাক ডেথ ইঁদুর হতে মানুষে এবং পরে মানুষ হতে মানুষে ছড়িয়ে পড়েছিল।
ঐতিহাসিকদের মতে, ইউরোপে ব্ল্যাক ডেথের প্রথম প্রাদুর্ভাব হয়েছিল ক্রিমিয়ান উপদ্বীপের কাফায়।
১৩৪৬ সালে, এই গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্রটি মঙ্গোল সেনাবাহিনী অবরোধ করেছিল, যাদের মাধ্যমে এই রোগ এশিয়া ও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এবং ইঁদুর বাহিত বানিজ্যিক জাহাজ ও মানুষের দ্বারা ইহা আমেরিকা ও আফ্রিকায় ও দ্বীপাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।



এই রোগটি পৃথিবী হতে নির্মূল করা যায়নি।
তবে আজকাল অ্যান্টিবায়োটি আবিস্কৃত হওয়ায় এই রোগের চিকিৎসা সহজ হয়েছে। চিকিৎসা করা না হলে এটির ৩০- ৬০% মৃত্যুর হার রয়েছে।
বুবোনিক প্লেগ, যা প্লেগের তিনটি রূপের একটি, এটি বেদনাদায়ক, বগলে ফোঁড়ার মত ফুলে উঠে (swollen lymph nodes) এবং এক প্রকার রস নি:সৃত হয়। লক্ষনগুলোর মধ্যে আরও রয়েছে জ্বর, সর্দি এবং কাশি ।
সন্দেহ করা হচ্ছে যে মারমোট হতে বর্তমানে চীনে চিহ্নিত হওয়া প্লেগটি ছড়িয়ে পড়েছে।
মারমাট হল এক ধরণের বড় বড় কাঠবিড়ালি যা চীন এবং পার্শ্ববর্তী দেশ মঙ্গোলিয়ার কিছু অংশে খাওয়া হয় এবং যা এই অঞ্চলে ঐতিহাসিকভাবে প্লেগের প্রকোপ সৃষ্টি করেছে।
বায়ানুর কর্তৃপক্ষ জনসাধারণকে মৃত বা অসুস্থ মারমোটের সন্ধান না করার বিষয়ে সতর্ক করেছে।

মঙ্গোলিয়ার খুখ লেকের চারপাশে মারমোটোর আবাসস্থল ও বিচরণ ক্ষেত্র বলে ধরা হয়।
মনে করা হয় যে, এই মারমোটই ১৯১১ সালের নিউমোরিক প্লেগের মহামারী সৃষ্টি করেছে, যা উত্তর-পূর্ব চীনে প্রায় ৬৩,০০০ মানুষকে হত্যা করেছিল। এটির পশম খুবই মূল্যবান এবং আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ীদের মধ্যে এর পশমের খুবই জনপ্রিয়তা ছিল।
রোগাক্রান্ত মারমোটের পশম পণ্যগুলি সারা দেশে বাণিজ্য ও পরিবহন করা হত বিধায় তখন ইহা সহস্রাধিক মানুষকে সংক্রামিত করে।
যদিও এই মহামারীটি এক বছরের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। তবে মারমোট সম্পর্কিত প্লেগ সংক্রমণ কয়েক দশক পরেও অব্যহত রয়েছে। সিংহুয়ার খবর অনুসারে, গত সপ্তাহে, মঙ্গোলিয়ায় দুই ভাই মারমোট মাংস খায় এবং ইহাতে তারা বুবোনিক প্লেগের আক্রান্ত হয়।
সিংহুয়ার তথ্য অনুসারে সোমবার, কর্তৃপক্ষগুলি মঙ্গোলিয়ায় বুবোনিক প্লেগের আরও একটি সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে সনাক্ত করেছে। ১৫ বছর বয়সী ঐ ছেলে মারমোট এর মাংস খেয়েছিল।
গত মে মাসে মঙ্গোলিয়ায় এক দম্পতি মারমোটের কাঁচা কিডনি খাওয়ার পরে বুবোনিক প্লেগের কারণে মারা গিয়েছিলেন, এটি খাওয়াকে সুস্বাস্থ্যের জন্য একটি রোগ প্রতিকার বলে মনে করা হয়েছিল। আরও দু’জন লোক নিউমোরিক প্লেগে আক্রান্ত হয়েছিল।
লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিকাল মেডিসিনের জনস্বাস্থ্যের অধ্যাপক জিমি হুইটওয়ার্থ বলেছেন, “যদিও প্লেগ গুরুতর অসুস্থতার কারণ হয়ে পড়ে, তবে তা যদি তাৎক্ষণিকভাবে ধরা পড়ে, তবে এটি সহজেই অ্যান্টিবায়োটিকের মাধ্যমে চিকিৎসা করা যায় এবং রোগীরা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবেন।”
সংবাদ প্রতিবেদনসমূহ ইঙ্গিত দেয় যে, অভ্যন্তরীণ মঙ্গোলিয়ায় এখন এটিই ঘটেছে, যার ফলে জনস্বাস্থ্যের কোনও ঝুঁকি নেই বলে বোঝানো হচ্ছে।
সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল হেলথের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ডাঃ মাইকেল হেড বলেছেন, প্লেগে আক্রান্তের বিষয়টি ” চীনের অভ্যন্তরীণ মঙ্গোলিয়ায় স্থানীয়ভাবে উদ্বেগের বিষয় হবে। তবে, এটি কোভিড ১৯-এর সাথে আমরা দেখেছি বলে বৈশ্বিক হুমকি হয়ে উঠবে না।”
যদিও আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় এই প্লেগটির চিকিৎসা করতে পারা যায় এবং যেহেতু এটি সম্পূর্ণরূপে পৃথিবী হতে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা যায়নি, সেহেতু এটি সাম্প্রতিক সময়ে প্রত্যাবর্তন করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা(WHO)এটিকে একটি পুনরায় উল্থিত রোগ হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করেছে।
WHO এর তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর এক হাজার থেকে শুরু করে ২ হাজার মানুষ প্লেগে আক্রান্ত হয়।
২০১৬ সালের তথ্যানুযায়ী, প্রায় প্রতিটি মহাদেশে, বিশেষত পশ্চিম আমেরিকা, ব্রাজিলের কিছু অংশ, দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অঞ্চল এবং চীন, ভারত এবং মধ্য প্রাচ্যের বিশাল অংশে প্লেগ হওয়ার আশংকা রয়েছে।
কঙ্গো, মাদাগাস্কার এবং পেরু গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র – এই তিনটি দেশে স্থায়ীভাবে প্লেগ রয়েছে।
রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রসমূহের তথ্য অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর কয়েক জন থেকে কয়েক ডজন প্লেগের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে।
২০১৫ সালে, কলোরাডোতে দুজন লোক প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল, এবং এক বছর আগে একই রাজ্যে আটটি ঘটনা ঘটেছিল। ২০১৭ সালে প্রাদুর্ভাবের সময় মাদাগাস্কার ৩০০ লোকেরও বেশি আক্রান্ত হয়েছিল।
তবে, মেডিকেল জার্নাল দ্য ল্যানসেটের এক গবেষণায় দেখা গেছে ৩০ জনেরও কম লোক মারা গেছে। তবে আপনি যদি প্রচুর বন্য প্রাণী এবং রোগ-বহনকারী ইঁদুরের মধ্যে বাস না করেন তবে আপনার সংক্রমণের আশংকা নাই।
চিকিৎসাবিহীন বুবোনিক প্লেগ আরও মারাত্মক নিউমোনিক প্লেগে পরিণত হতে পারে, যার ফলে ব্যাকটিরিয়া ফুসফুসে ছড়িয়ে যাওয়ার পরে নিউমোনিয়ায় দ্রুত মারাত্বক হওয়ার আশংকা থাকে।
Sources: CNN and BBC