বিশ্ব পানি দিবস- ২০২৪ এর তাৎপর্য
আজ ২২ মার্চ, ২০২৪ বিশ্ব পানি দিবস।
বৈশ্বিক পানি ও স্যানিটেশন সংকট মোকাবেলায় সচেতনতা বৃদ্ধি এবং অনুপ্রাণিত করার উদ্দেশ্যে ১৯৯২ সালের রিও ধরণী সম্মেলন (UN Conference on Environment and Development/UNCED “Earth Summit”– Rio) এ গৃহীত সিদ্ধান্তানুযায়ী ১৯৯৩ সাল হতে প্রতিবছর বছর ২২ মার্চ এ দিনটি পানি দিবস হিসাবে উদযাপিত হয়ে আসছে।এখানে পানি বলতে স্বাদু বা মিঠা পানি (Fresh Water) বুঝানো হয়েছে।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (Sustainable Development Goals– SDG) বা এজেন্ডা-২০৩০ (Agenda-2030) এর লক্ষ্যমাত্রা: ৬: সকলের জন্য পানি এবং স্যানিটেশন (Water and Sanitation for all by 2030) কে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে এ দিবসটি পালনের গুরুত্ব এবং প্রতিপাদ্য নির্বাচন করা হয়।
চলতি ২০২৪ সালের পানি দিবসের প্রতিপাদ্যটি হলো – “শান্তির জন্য পানির ব্যবহার(Leveraging Water for Peace)।”
পানি বিশ্বের দেশসমূহের মধ্যে শান্তি সৃষ্টি করতে পারে বা সংঘর্ষেরও জন্ম দিতে পারে।
পানি জীবনের জন্য অপরিহার্য, তবুও, পরিবেশের কারণে বা প্রাকৃতিক বা মানব-সম্পর্কিত দূষণের কারণে বিশ্বজুড়ে পানির অভাব রয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, এই জীবনদানকারী সম্পদে প্রবেশাধিকারের অভাব সম্প্রদায় ও জাতির মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছে।
যখন পানির অভাব হয় বা তা দূষিত হয়, বা যখন সে পানিতে মানুষের মধ্যে অসম অধিকার দেখা দেয়, বা সকল পক্ষের সমান বা আদৌ প্রবেশাধিকার থাকে না, তখন সম্প্রদায় এবং সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হতে পারে।
বিশ্বব্যাপী ১৫৩টি দেশের ৩ বিলিয়নেরও বেশি মানুষ আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করা পানির উপর নির্ভর করে। এর মধ্যে শুধুমাত্র ২৪টি দেশের মধ্যে তাদের সকল পানির হিৎসা বন্টনে সহযোগিতা চুক্তি হয়েছে।
যেহেতু বর্তমান সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং জনসংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাই বিশ্ববাসির সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ পানি রক্ষা ও সংরক্ষণে একত্রিত হওয়ার জন্য দেশ ও জাতিগুলির মধ্যে সকল মতভেদ দূর করে জরুরিভিত্তিতে একতা প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন৷
জনস্বাস্থ্য ও সমৃদ্ধি, খাদ্য ও শক্তি ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা এবং পরিবেশগত অখণ্ডতা সকল বিষয় একটি সুষ্ঠু ও কার্যকরী এবং সুষমভাবে পরিচালিত পানিচক্রের উপর নির্ভর করে।
বিশ্ব পানি দিবস ২০২৪–এর মূল বার্তা
- পানি শান্তি বা সংঘাত সৃষ্টি করতে পারে। যখন পানির অভাব হয় বা দূষিত হয়, অথবা যখন মানুষ ন্যয্য হিৎসার জন্য সংগ্রাম করে, তখন উত্তেজনা বাড়তে পারে। সকল পক্ষের পানি প্রাপ্তির বিষয়ে সহযোগিতা করে আমরা প্রত্যেকের পানির চাহিদার ভারসাম্য বজায় রাখতে পারি এবং বিশ্বকে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করতে পারি।
- সমৃদ্ধি এবং শান্তি পানির উপর নির্ভর করে। যেহেতু বর্তমানে বিশ্ব প্রচন্ডভাবে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত খারাপ প্রভাব, ব্যাপক অভিবাসন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা মোকাবেলা করছে, মিঠা পানির রাজনৈতিক সমাধান ও সংশ্লিষ্ট দেশ বা জাতিসমূহের মধ্যে মিঠা পানির সুসম বন্টন চুক্তি বিশ্বকে উক্ত প্রভাব মোকাবেলায় সহযোগিতা করতে পারে।
- পানি আমাদের সঙ্কট থেকে বের করে আনতে পারে। আমরা সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের মধ্যে পানির ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এবং এর টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে পরস্পর ঐক্যবদ্ধ হয়ে পানির সমস্যা সমাধান করতে পারি এবং দেশগুলির মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখতে পারি। আন্তর্জাতিক স্তরে জাতিসংঘের সম্মেলন থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ে পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এ সমস্যা দূর করতে পারি।
পানির বিষয়ে কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ এর ২০২৩ এর রির্পোট অনুযায়ী বিশ্বের ২.২ বিলিয়ন মানুষ এখনও নিরাপদ পানীয় পানি (Drinking Water) ছাড়াই বসবাস করে, যার মধ্যে ১১৫ মিলিয়ন মানুষ যারা ভূপৃষ্ঠের পানি পান করে।
- IPCC এর ২০২২ সালের রির্পোট অনুযায়ী বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই বছরের অন্তত কিছু অংশে তীব্র পানি সংকটে পতিত হয়।
- বিশ্বব্যাংকের ২০২২ সালের রির্পোট অনুযায়ী পানি-সম্পর্কিত বিপর্যয়গুলি বিগত ৫০ বছরে দুর্যোগের তালিকায় প্রাধান্য পেয়েছে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে সম্পর্কিত সমস্ত মৃত্যুর ৭০ শতাংশের জন্য দায়ী।
- জাতিসংঘের ২০২৩ সালের তথ্য মতে বিশ্বের পানি প্রবাহের ৬০ শতাংশের আন্তঃসীমান্ত নদীর উপর নির্ভরশীল এবং বিশ্বের ৩১০ টি আন্তঃসীমান্ত নদী, হ্রদ ও অববাহিকা এবং আবিস্কৃত ৪৬৮টি প্রাকৃতিক আন্তঃসীমান্ত ভূ-গর্ভস্থ পানির সংরক্ষণগারের মধ্যে ১৫৩ টি দেশের অন্তত ১ টি অঞ্চল রয়েছে যা প্রতিবেশী দেশের সাথে পানি ভাগ করে ব্যবহারযুক্ত বা নির্ভরশীল।
- সমষ্টিগতভাবে, সারা বিশ্বে মহিলা এবং মেয়েরা প্রতিদিন ২০০ মিলিয়ন ঘন্টা পানির জন্য হাঁটতে হয়।
- প্রতি বছর বৈশ্বিক কারণে পানি সংকটে ৪৪৩ মিলিয়ন স্কুল দিন মিস হয় ।
- পানি সংক্রান্ত অসুস্থতার কারণে প্রতি বছর ৮২৯০০০ মানুষ মারা যায়।
- প্রতি নিরাপদ পানির জন্য ১ মার্কিন ডলার বিনিয়োগ ৬.৮০ মার্কিন ডলার অর্থনৈতিক রিটার্ন পাওয়া যায়।
- উন্নয়নশীল বিশ্বের হাসপাতালের ৫০% বিছানা ভরা থাকে পানি সংক্রান্ত আক্রান্ত রোগের রোগী দ্বারা।
- বিশ্বের ৩.৬ বিলিয়ন মানুষের পর্যাপ্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থা অনুপস্থিত।
এসডিজি:৬ হ’ল এ বিশ্ববাসীর সবার জন্য পানি এবং স্যানিটেশন নিশ্চিত করা। পানির অপরিহার্যতা এবং এর বহুমাত্রিক মূল্য সম্পর্কে আমাদের বিস্তৃত ধারণা না থাকলে আমরা এ সংকটপূর্ণ মহামূল্যমান সম্পদটি বিশ্ববাসীর কল্যানের জন্য রক্ষা করতে পারব না।
পানি ছাড়া পৃথিবীতে বেঁচে থাকা অসম্ভব। পানি পান ব্যতীত মানুষ তিন বা চার দিনের বেশি বাঁচতে পারি না। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দেহের ৬০% অবধি পানি।
আমাদের সৌরজগতের গ্রহগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র পৃথিবীতে পানি রয়েছে বিধায় পৃথিবীতে জীবন রয়েছে। অন্যান্য গ্রহে পানি নেই; তাই অন্য গ্রহে কোন জীবনও নেই।
মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পানি অপরিহার্য। পানি ব্যাতিত আমরা এক মুহুর্তে চলতে পারি না। আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তুর উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, পরিবহনে প্রয়োজন পানির। পানিই জীবন, জীবনই পানি।
আমাদের এ পৃথিবীর ভূ-উপরিস্থতলের দুই তৃতীয়াংশ পানি এবং এক তৃতীয়াংশ স্থল রয়েছে। কিন্তু মানুষের ব্যবহায্য ও পান করার পানির পরিমান খুবই সীমিত।
উপরের চিত্র হতে দেখা যায় যে, পূথিবীতে যত পানি রয়েছে তার মধ্যে ৯৭% লবন পানি এবং মাত্র ৩% মিঠা পানি। আবার, এ ৩% মিঠা পানির ৬৮.৭% বরফ, বরফের শীট ও হিমবাহ, ৩০.১% ভূ- গর্ভস্থ পানি এবং মাত্র ০.৩% ভূ –উপরস্থ মিঠা পানি। আবার এ ০.৩% এর ৮৭% বিভিন্ন হ্রদে রয়েছে, যার মধ্যে শুধু বৈকাল হ্রদেই রয়েছে পৃথিবীর অর্ধেক মিঠা পানি, ১১% রয়েছে বিভিন্ন জলাভূমি (Swamps) তে এবং মাত্র ২ % নদী, খাল- বিলে রয়েছে বিশ্ববাসীর ব্যবহারের জন্য।
সুতরাং কত নগণ্যই না রয়েছে মানুষের ব্যবহারযোগ্য ও পান করার পানি।
অথচ এটুকু পানিই বর্তমান বিশ্বের ৭.৮ বিলিয়ন মানুষসহ সমগ্র প্রাণী জগৎ এবং প্রায় ৯০% উদ্ভিদ জগৎ ব্যবহার করছি। আমরা পান করছি, দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করছি, কৃষিতে, শিল্পে, মৎস চাষে ব্যবহার করছি। আবার নির্বোধের মত কতনা ভাবে দূষিত করছি, বিষাক্ত করছি।
তাই এটুকু পানিতে বিশ্বের সকল দেশের সকলস্তরের মানুষের নিরাপদ প্রাপ্তি বা প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন এবং ইহা মানবধিকারও বটে।