বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০২৩
আজ ৫ই জুন, ২০২৩, বিশ্ব পরিবেশ দিবস।
UN এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম (UNEP) প্রতি বছর এই দিনটি বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসাবে পালন করে আসছে।
১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত জাতি সংঘের স্টকহোম মানব পরিবেশ সম্মেলন (UN Stockholm Conference on the Human Environment in 1972) কর্তৃক এ দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং এক বছর পরে ১৯৭৩ সালে প্রথম বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হয়। এই বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদযাপনের ৫০ তম বার্ষিকী পালিত হচ্ছে৷
আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে জীবিত এবং নির্জীব (living and non-living elements) এবং আমাদের সাথে ও উহাদের একে অপরের সাথে যে আন্তঃযোগাযোগ/প্রতিক্রিয়া করে (interact with us and each other) এ সকল বিষয় নিয়েই আমাদের পরিবেশ।
পরিবেশের সকল অঙ্গের মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সহ-অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য পরিবেশ বিবর্তিত হয়। যখন এক বা একাধিক উপাদান নিয়ন্ত্রণের বাইরে প্রসারিত হয় তখন পরিবেশের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়।
এ বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবস এর প্রতিপাদ্য(Theme)টি হল “প্লাষ্টিক দূষণ বন্ধ কর-Beat Plastic Pollution),” এবং ইহা সোশ্যাল মিডিয়া হ্যাশট্যাগ #BeatPlasticPollution এর সাথে শেয়ার করা হয়েছে।
২০২৩ এর বিশ্ব পরিবেশ দিবসের এই প্রতিপাদ্য #BeatPlasticPollution প্রচারাভিযানের অধীনে প্লাস্টিক দূষণের সমাধানের উপর বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
বর্তমানে প্লাস্টিক দূষণ মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। ইহা প্রতিরোধে পরিবেশ-বান্ধব উপকরণ দিয়ে প্লাষ্টিক উপকরণ প্রতিস্থাপন করার জরুরি পদক্ষেপ গ্রহন প্রয়োজন।
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ আইভরি কোস্ট বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০২৩ এর হোষ্ট (Host country) এবং নেদারল্যান্ডস এ বছর এর অংশীদার হিসাবে ভূমিকা রাখছে। আইভরি কোষ্ট ইতিমধ্যে প্লাস্টিকের ব্যাগ নিষিদ্ধ করেছে।
জাতিসংঘের হিসাবে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ৪০০ মিলিয়ন মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এর ৫০ শতাংশই একবার ব্যবহৃত (Single use) প্লাষ্টিক সামগ্রী যেমন, পানির বোতল, জুসের বোতল, প্লাষ্টিকের ব্যাগ ইত্যাদি হতে উৎপন্ন হয় এবং এর মাত্র ৯ শতাংশ পুনর্ব্যবহৃত হয়।
এত প্লাস্টিক বর্জ্য কোথা থেকে আসছে?
উৎপাদিত মোট প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রায় ৩৬% উৎপন্ন হয় ভোগ্যপণ্য দ্রব্যের প্যাকেজিং শিল্প হতে। এরূপ প্লাষ্টিক বর্জ্য প্রতি বছর ৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যমানের পরিবেশের ক্ষতি করে।
বছরে ১২.৫০ মিলিয়ন মে. টন প্লাস্টিক পণ্য উদ্ভিদ এবং প্রাণী (পশু, পাখী, মৎস ইত্যাদি) উৎপাদন খাত হতে আসে।বছরে ৩৭.৫০ মিলিয়ন মে. টন প্লাষ্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয় খাদ্য প্রক্রিয়া জাত ও প্যাকেজিং শিল্প হতে।
প্রসাধণী দ্রব্যাদি বিশেষ করে সুন্দর ও রূপ চর্য়ায় ব্যবহৃত প্রসাধণী সামগ্রী যেমন, উন্নত মানের সাবান, সেম্পু, গোছলের জেল, পেস ওয়াশ, বডি লোশণ, সৌন্দর্য় বর্ধণকারী ক্রীম ইত্যাদি হতেও প্রচুর পরিমানে মাইক্রোপ্লাষ্টিক উৎপন্ন হয়। এ সকল পণ্য ব্যবহারকারী একজন ব্যক্তির একবার স্নান করলে নূন্যতম ১ লক্ষ মাইক্রো প্লাষ্টিক পানিতে মিশ্রিত হয়।
প্রায় একচেটিয়া ভাবে একবার ব্যবহার্য্য প্লাস্টিক পণ্য জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে তৈরি করা হয় এবং গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমনের ৩.৪% দায়ী জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক উৎপাদনে।
পোশাক তৈরির প্রায় ৬০% উপাদানই প্লাস্টিক। শুধুমাত্র পোষাক শিল্পের কাপড় রং করণ, ধৌত করণের কারণে প্রতি বছর প্রায় ৫,০০,০০০ মে. টন প্লাষ্টিক বর্জ্য সাগরের পানিতে মিশ্রিত হয়।
গাড়ি শিল্পে ৩০% প্লাস্টিকের উপাদান ব্যবহৃত হয়। পর্যটকদের কারণে উপকূলীয় এলাকায় প্রতি বছর 8 মিলিয়ন টন প্লাস্টিক সমুদ্রে প্রবেশ করে।
ইলেকট্রনিক্স থেকে শুরু করে চিকিৎসা ডিভাইস এবং শিশুদের খেলনা সবকিছুতেই প্লাস্টিক পাওয়া যায়। এই পণ্যগুলিতে ক্ষতিকারক রাসায়নিক সংযোজন অন্তর্ভুক্ত থাকে যা প্রাণী ও উদ্ভিদের স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
এসব প্লাষ্টিক বর্জ্য কোথায় যায়?
উৎপাদিত প্লাস্টিক পণ্যের ৯% পূর্ণর্ব্যবহৃত হয় (Recycled), ১৭% দূষণ ছড়ানো বিহীন বিশেষ ব্যবস্থায় পোড়ানো হয় (Incinerated), ৪৬% বর্জ্য শোধনাগারে পাঠানো হয় (Landfilled) এবং ২২% সংগ্রহহীন ও অব্যবস্থাপনা (Mismanaged, uncollected) থেকে যায়।
সংগ্রহহীন ও অব্যবস্থাপনা থেকে যাওয়া সকল প্লাস্টিক বর্জ্য পানি নিষ্কাশনে বাঁধা সৃষ্টি করছে, মাটির সাথে মিশে জমির উর্বরতা নষ্ট করছে, প্লাস্টিক বর্জ্য ভূমি দখল করে গাছ-গাছালী ও কৃষি জমির পরিমান হ্রাস করছে, পরিবেশ নোংরা করছে, যত্রতত্রভাবে প্লাস্টিক বর্জ্য পোঁড়ানোয় মারাত্বক বায়ু দুষণের সৃষ্টি করছে এবং নদী, হ্রদ ও মহাসাগরে প্রবেশ করে সামুদ্রিক জীবনকে বিপন্ন করছে।
সমুদ্রে যে সকল প্লাস্টিক বর্জ্য যায় কালের প্রবাহে সে গুলো টুকরো টুকরো হয়ে মাইক্রো প্লাস্টিক এ পরিনত হচ্ছে। শিল্প খাত ও ব্যবহৃত প্রসাধণী সামগ্রী হতে নির্গত মাইক্রোপ্লাস্টিকও সমুদ্রে যেয়ে সমুদ্রের পানিতে মিশে যাচ্ছে।
সমুদ্রের পানিতে মিশ্রিত এসব মাইক্রোপ্লাস্টিক সামুদ্রিক মাছ ও খাবার লবণের মাধ্যমে মানব দেহে ফিরে আসছে এবং মানব দেহে মারাত্বক জটিল রোগের সৃষ্টি করছে।
শুধু তাই নয়, যা কম জানা যায় তা হল যে, আমরা যে খাবার খাই, আমরা যে জল পান করি এবং এমনকি আমরা শ্বাস নেওয়া বাতাসেও মাইক্রোপ্লাস্টিককগুলি মিশ্রিত থাকে। অনেক প্লাস্টিক পণ্যে বিপজ্জনক সংযোজন রয়েছে, যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে যে মাইক্রোপ্লাষ্টিক বা প্লাষ্টিকের ধ্বংসাবশেষ দ্বারা দূষিত পদার্থ শ্বাস-প্রশ্বাস, খাদ্য গ্রহণ এবং পানির মাধ্যমে আমাদের দেহে প্রবেশ করছে এবং তা আমাদের রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করেছে।
প্লাস্টিকের রাসায়নিক সংযোজন অন্তঃস্রাবের ব্যাঘাত, প্রজনন সমস্যা, ডায়াবেটিস, স্থুলতা, হাঁপানি, নিউরোডেভেলপমেন্টাল ত্রুটি এবং এমনকি ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। এগুলি সময়ের সাথে সাথে আমাদের অঙ্গগুলিতে, বিশেষত আমাদের ফুসফুস, লিভার, কিডনি এবং প্লীহাতে জমা হয়।
পৃথিবীর যত্রতত্র এ প্লাষ্টিক পণ্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরিবেশের বিষম ক্ষতি করছে। এনর্টার্টিকা মহাদেশ হতে শুরু করে উত্তর মেরু পর্যন্ত পৃথিবীর সর্বত্রই এখন প্লাষ্টিক বর্জ্যের দূষণে দুষিত হয়ে গিয়েছে, এমনকি এভারেস্টে পর্বত শৃঙ্গেও প্লাষ্টিক বর্জ্য পাওয়া যাচ্ছে।
বিশ্বে প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করার জন্য জাতিসংঘের পরিবেশ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত একটি প্রস্তাবে জাতিসংঘের ১৭৫ টি সদস্য রাষ্ট্রসমূহ ২রা মার্চ, ২০২২-তে স্বাক্ষর করেছে যার ভিত্তিতে ২০২৪ সালের মধ্যে প্লাস্টিক দূষণ হ্রাসে এতদসংক্রান্ত একটি আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক চুক্তি প্রণয়ন করা হবে।
নেদারল্যান্ডের পরিবেশ মন্ত্রী ভিভিয়ান হেইজেন বলেছেন, “প্লাস্টিক দূষণ এবং স্বাস্থ্য, অর্থনীতি এবং পরিবেশের উপর এর ক্ষতিকর প্রভাব উপেক্ষা করা যায় না। এ দূষণ প্রতিরোধে জরুরী পদক্ষেপ প্রয়োজন। + একই সময়ে এ দূষণ প্রতিরোধে আমাদের সত্যিকার, কার্যকর এবং শক্তিশালী সমাধান দরকার,”। “প্লাস্টিককে বেশ কয়েকটি নীতির অংশ হিসাবে বিবেচনা করা হয়, নেদারল্যান্ডস এবং ইউরোপীয় সম্প্রদায় একবার ব্যবহৃত প্লাস্টিকের উৎপাদন এবং ব্যবহার কমাতে সম্পূর্ণরূপে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যা টেকসই এবং টেকসই বিকল্পগুলির সাথে প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে।“
প্লাস্টিক বর্জ্য বন্ধ বা হ্রাস (Beat Plastic Pollution) করতে হলে সরকারীভাবে, বানিজ্যিকভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে একবার ব্যবহৃত (Single use) প্লাস্টিক পণ্যের উৎপাদন, মজুদ, বাজারজাত ও ব্যবহার ধাপে ধাপে বন্ধ করতে হবে এবং তার পরিবর্তে পচনযোগ্য অথবা পুনর্ব্যবহারযোগ্য (Biodegradable or Reusable)পণ্য দ্বারা সেগুলো প্রতিস্থাপন (Replacement)করতে হবে।
আমাদের দৈনন্দিন একবার ব্যবহারযোগ্য (Single use) প্লাস্টিক পণ্যের বিপরীতে নিন্মে পচনযোগ্য অথবা পুনর্ব্যবহারযোগ্য পরিবেশ বান্ধব কতিপয় প্ণ্য উল্লেখ করা হলো, যেগুলো ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলে ধীরে ধীরে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার হ্রাস পাবে। ফলে প্লাটিক বর্জ্যেরও উৎপাদন হ্রাস পেতে থাকবে।
Sources: News18, UN Environment Programme ( Solutions to Plastic Pollution)