জলবায়ু পরিবর্তন: বিশ্ব তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে শতশত কোটি বিশ্ববাসী ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে পড়বে
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন যতই বৃদ্ধি পাচ্ছে মানব সমাজে ততই নতুন নতুন রোগের আর্বিভাব ঘটছে এবং পুরাতন রোগগুলোরও পূণঃআর্বিভাব হচ্ছে। মশাবাহিত ম্যালিরিয়া, ডেঙ্গু, চিকনগোনিয়া রোগগুলোর কথাই ধরিনা কেন।
বিশ্ব তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে শতশত কোটি বিশ্ববাসী ম্যালেরিয়া এবং ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে পড়বে। উষ্ণায়ন বৃদ্ধির সাথে সাথে বিশ্বে বৃষ্টিপাত, বন্যা ও তুষারপাত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইহাতে স্যাঁতসেতে পরিবেশ ও বিভিন্ন স্থানে স্বল্প পরিসরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ার কারনে মশার প্রজনন স্থানের বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং প্রজননের উপযুক্ত পরিবেশের সৃষ্টি হচ্ছে।
ফলে মশার দ্রুত বংশ বৃদ্ধি ঘটছে। এ ছাড়াও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে গরম পরিবেশে মশার বংশবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হচ্ছে। অধিকন্ত, উষ্ণায়ন বৃদ্ধির কারণে গরমকাল দীর্ঘতর হওয়ায় মশার প্রজনন সময়েরও বৃদ্ধি ঘটছে।
আবার বৈশ্বিক উষ্ণায়ণ বৃদ্ধি পাওয়ায় উত্তর গোলার্ধের দিকে নাতিশীতষ্ণু অঞ্চলের প্রসারণ ঘটছে, অর্থাৎ উত্তর ইউরোপ, রাশিয়া, কানাডার মত অঞ্চলের দিকে গরম পড়া শুরু হচ্ছে।
এর সাথে সাথে উষ্ণ ও নাতিশীতষ্ণু অঞ্চলের মশারও বিচরণ ক্ষেত্র উত্তর গোলার্ধের দিকে সম্প্রসারিত হচ্ছে। ফলে বিশ্বে মশারও প্রজনন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে মশাবাহিত রোগেরও বিস্তার ঘটছে।
সাম্প্রতিক সময়ে পরিচালিত একটি দেখা গেছে যে, বিশ্ব উষ্ণতা প্রতিনিয়ত পৃথিবীতে বন্যা ও খরার ছাপ বাড়িয়ে তুলেছে; এখন এটির জন্য বিশ্বে বিভিন্ন মরণ ব্যাধির আর্বিভাব ঘটছে।
২১০০ সালের মধ্যে প্রাক-শিল্প (১৭৫০ সাল) স্তর থেকে তাপমাত্রায় ৩.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়ে (যদিও প্যারিস চুক্তিতে এ শতাব্দিতে তাপমাত্রার বৃদ্ধি ২ ড্রিগী সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখার কথাবলা হয়েছে, কিন্ত্ত অবস্থা দৃষ্টিতে তা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না) ম্যালেরিয়া এবং ডেঙ্গুর মারাত্মক প্রকোপ দেখা দিতে পারে বলে উক্ত গবেষণায় দাবি করা হয়েছে।
দ্য ল্যানসেট প্ল্যানেটারি হেলথ (The Lancet Planetary Health)-এ প্রকাশিত সমীক্ষাটিতে বলা হয়েছে যে, ১৯৭০-৯৯ সালের তুলনায় প্রায় ৮৭০ কোটি মানুষ আরও মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
গবেষকরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সাথে সংক্রমণ মৌসুমের দৈর্ঘ্যের পরিমাপ করতে একটি সমন্বিত মাল্টি-মডেল মাল্টি-পরিস্থিতির কাঠামো ব্যবহার করেছেন (used an integrated multi-model multi-scenario framework to measure the impact of climate change in the length of the transmission season)।
১৯৫১-৯৯ সময়কালে ভূ-পৃষ্টের বিভিন্ন উচ্চতা ও উষ্ণায়ণ এবং জনসংখ্যার ঘনত্বের জন্য ম্যালেরিয়া এবং ডেঙ্গু হওয়ার ঝুঁকিতে বিশ্ব জনসংখ্যা পরিমাপ করতে তারা এটি ব্যবহার করেছিল।
এই গবেষণায় লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিকাল মেডিসিন (London School of Hygiene & Tropical Medicine) নেতৃত্ব উমেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সুইডেন (Umeå University, Sweden), আবদুস সালাম ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরিটিকাল ফিজিক্স, ইতালি (Abdus Salam International Centre for Theoretical Physics , Italy), হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়, জার্মানি (Heidelberg University, Germany) এবং লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয় (University of Liverpool) অংশগ্রহন করে।
সমীক্ষায় ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (World Health Organization-WHO) আফ্রিকান অঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চল এবং আমেরিকার অঞ্চলগুলোর জনবহুল শহরগুলোতে বেশি লোক ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গু হওয়ার ঝুঁকিতে থাকবে।
এটি আরও অনুমান করা হয়েছে যে, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শহরাঞ্চলে ১৪০ কোটির বেশি লোক ম্যালেরিয়া এবং ডেঙ্গু হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বেন।
Chikungunya virus transmits by two species of mosquitoes: Aedes aegypti and Aedes albopictus, more commonly known as the Asian tiger mosquito |
সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উভয় রোগের সংক্রমণ মৌসুমের দৈর্ঘ্যের বৃদ্ধি ঘটবে। কারণ, সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, শীতকাল গরম ও সংক্ষিপ্ত হচ্ছে এবং গ্রীষ্মের আগমন আগেই হচ্ছে ও দৈর্ঘ্য সম্প্রসারণ ঘটছে। তাই মশার মতো ভেক্টররা (রোগের জীবানু বাহকরা) বংশবৃদ্ধির জন্য বেশি সময় পাচ্ছে এবং পরিবেশ অধিক অনুকুল হচ্ছে।
সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, আফ্রিকার ক্রান্তীয় উচ্চভূমি, পূর্ব ভূমধ্যসাগর এবং আমেরিকা অঞ্চলে ম্যালেরিয়া সংক্রমণের ঝুঁকি আরও ১.৬ গুণ বৃদ্ধি পাবে। পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরের নিম্নাঞ্চলগুলোতে ডেঙ্গু সংক্রমণের ঝুঁকি আরও ৪ মাস বৃদ্ধি পাবে।
সমীক্ষায় সুপারিশ করা হয়েছে যে, বিশ্বের নীতি নির্ধারকদের উষ্ণতর ও নগরায়িত বিশ্বে মশারিবাহিত রোগসমূহের প্রতিরোধের জন্য উপযুক্ত কৌশল তৈরি করা উচিত।
গবেষণায় আরও স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে যে, গবেষকরা আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, রোগ এবং ভেক্টর বিবর্তনের প্রভাব বা আরও কার্যকর ওষুধ ও ভ্যাকসিনসমূহের বিকাশের বিষয়টি বিবেচনা করছে না বিধায় এগুলো সবই ঝুঁকির পরিমাণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য দেখা দিতে পারে।
জীব বিজ্ঞানী ইরিন মোরদেকাই, যিনি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় (Stanford University) এ উষ্ণ জলবায়ু এবং সংক্রামক রোগ নিয়ে পড়াশোনা করছেন, তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলছেন যে “যদি বিশ্ব জলবায়ু সংক্রমণ রোগজীবানুর জন্য আরও অনুকূল হয়ে উঠে, তবে মশার নিয়ন্ত্রণ করা আরও কঠিন ও কঠিনতর হবে।” তিনি এর সাথে যোগ করেছেন: “এটি আপনার জন্য আসছে”।
References:
- The Lancet Planetary Health
- Down to Earth – Global warming can put billions at risk of malaria, dengue: Study by Madhumita Paul
- Business Insider – How climate change could make infectious diseases even more difficult to combat in the future by Natalie Colarossi
- WIKIPEDIA