বায়ু দূষণের অন্যতম কারন হচ্ছে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজ
সরকারি বড় অবকাঠামো ও স্থাপনা নির্মাণ থেকে গত কয়েক বছরে সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ হয়েছে। ঘরে বসেও মানুষ বায়ুদূষণ থেকে নিরাপদ থাকতে পারছে না। বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) গবেষণায় এমন তথ্যই উঠে এসেছে।
রবিবার রাজধানীতে বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এবং ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ এর যৌথ আয়োজনে ‘নির্মল বায়ু নিশ্চিত করণ: প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক একটি জাতীয় সংলাপের আয়োজন করে।
সংলাপে মূল প্রবন্ধে বলা হয়, দেশে জেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর গাজীপুর। গাজীপুরের বাতাসে অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা যার ব্যাস সাধারণত ২ দশমিক ৫ মাইক্রোমিটার বা এর চেয়ে ছোট (পিএম ২.৫), এর ঘনত্ব প্রতি ঘনমিটারে ৮৯ দশমিক ৮ মাইক্রোগ্রাম।
এই মান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানমাত্রার (৫ মাইক্রোগ্রাম) চেয়ে ১৮ গুণ বেশি। দেশের সবচেয়ে কম দূষিত জেলা সিলেট শহর। সেখানে অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণার ঘনত্ব প্রতি ঘনমিটারে ৪৮ দশমিক ৫ মাইক্রোগ্রাম।
এটিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানমাত্রার চেয়ে ৯ দশমিক ৭ গুণ বেশি এবং বাংলাদেশের নির্ধারিত জাতীয় আদর্শ (বার্ষিক) মানমাত্রার চেয়েও ৩ দশমিক ২৩ গুণ বেশি।
বায়ুদূষণের কারণগুলোর মধ্যে প্রাকৃতিক ও আবহাওয়াজনিত কারণ, নগর-পরিকল্পনায় ঘাটতি, আইনের দুর্বলতা, আইন প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা, ভৌগোলিক কারণ এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব অন্যতম বলে গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ক্যাপসের গবেষণায় পাওয়া গেছে, সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ হয় রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজ থেকে—৩০ শতাংশ। এরপরেই আছে ইটভাটা ও শিল্পকারখানা—২৯ শতাংশ।
এ ছাড়া যানবাহন থেকে ১৫ শতাংশ, আন্তর্দেশীয় বায়ুদূষণ থেকে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ, গৃহস্থালি ও রান্নার চুলা থেকে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ এবং বর্জ্য পোড়ানো থেকে ৮ শতাংশ বায়ুদূষণ ঘটে।
বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশের একজন নাগরিকের গড় আয়ু কমছে ৬ বছর ৮ মাস। এ ছাড়া ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডিজিজেস অব দ্য চেস্ট এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স–২০২৩ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বের সব মানুষের গড় আয়ু দুই বছর চার মাস কমছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডিজিজেস অব দ্য চেস্ট অ্যান্ড হসপিটালে ২০২১ সালে আউটডোর এবং জরুরি বিভাগ মিলিয়ে ২ লাখ ১০ হাজার রোগী চিকিৎসাধীন ছিলেন।
সাত বছর আগে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৮৫ হাজার। অন্যদিকে রাজধানীর জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটের হিসাবে দেখা গেছে, গত বছরের জুলাই মাসে হাসপাতালে ভর্তি, আউটডোর ও জরুরি বিভাগ মিলে রোগীর সংখ্যা ছিল ১২ হাজারের কিছু বেশি। সেখানে চলতি বছরের জুলাইয়ে সে সংখ্যা ১৪ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, সিসা দূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর হৃদ্রোগে আক্রান্ত হচ্ছে ১ লাখ ৩৮ হাজারের বেশি মানুষ। এ কারণে শিশুদের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।
সংলাপে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘দেশে এক ধরনের বিকলাঙ্গ উন্নয়ন হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, হাত দুটো খুব শক্তিশালী, কিন্তু পা দুটো চিকন হয়ে যাচ্ছে ৷
জনস্বাস্থ্যের বিষয়গুলো ভাবলে দেখা যাবে, আমরা যে উন্নয়ন করছি, তাকে উন্নয়ন বলা যাচ্ছে না। এটা স্টাডি করা দরকার—বায়ুদূষণের কারণে জাতি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
এ সময় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘জলবায়ু ও পরিবেশের সঙ্গে জনস্বাস্থ্যের বিষয়ও চলে এসেছে।
বায়ুদূষণকে জিরো টলারেন্স হিসেবে দেখতে হবে। আমরা যেমন বলি সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদের ক্ষেত্রে আমাদের জিরো টলারেন্স, তেমনি বায়ুদূষণের ক্ষেত্রেও একইভাবে জিরো টলারেন্স নীতিতে আমাদের চলতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তর এককভাবে কিছু করতে পারবে না।’
ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশের (আইএবি) ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী নকীর সভাপতিত্বে এবং ক্যাপস প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদারের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন—ক্লাইমেট পার্লামেন্ট বাংলাদেশের সদস্য আহসান আদেলুর রহমান আদেল, অর্থ মন্ত্রণালয়বিষয়ক সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য রানা মোহাম্মদ সোহেল, সুইডেন দূতাবাস বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিভাগের ফাস্ট সেক্রেটারি ডেনিয়েল নোভাক, পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন প্রমুখ।