বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা -২১০০: দূর্যোগ প্রশমনের মাধ্যমে বাঙ্গালী জাতির শত বছরের অর্থনৈতিক মুক্তির সনদ
বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। বঙ্গোপসাগরের উত্তরে গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্র নদী দ্বারা গঠিত বদ্বীপের দুই-তৃতীয়াংশ নিয়ে এই অঞ্চলটি গঠিত। এই অঞ্চলের উত্তর-পশ্চিমে প্রাচীন পলল দ্বারা গঠিত ছোট কিন্তু কিছুটা উঁচু দুটি এলাকা রয়েছে যা বরেন্দ্র ভূমি এবং মধুপুর ট্র্যাক্ট নামে পরিচিত।
বাংলাদেশের প্লাবন ভূমি-৮০%, পাহাড়ি অঞ্চল-১২%, সোপান এলাকা-৮%। পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা নদীর মিলনস্থলে গড়ে উঠেছে পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহত্তম গতিশীল এ ব-দ্বীপটি, ছোট-বড় প্রায় ৭০০ নদ-নদী, ৫৭ টি আন্তঃদেশীয় নদী (৫৪ টি ভারতের সাথে ও ৩ টি মায়ানমারের সাথে সংযুক্ত)। বছরভিত্তিক প্রবাহিত পলির পরিমাণ প্রায় ১.০-১.৪ বিলিয়ন টন। বর্ষা মৌসুমে পানির আধিক্য আর শুল্ক মৌসুমে পানির স্বল্পতা রয়েছে।
মানণীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী চিন্তা প্রসূত ব-দ্বীপ পরিকল্পানা ২১০০ একটি দীর্ঘমেয়াদী আন্তঃখাত সমন্বিত, জলবায়ু অভিযোজন ভিত্তিক কারিগরি ও অর্থনৈতিক মহাপরিকল্পনা।
দীর্ঘ মেয়াদে উন্নয়নকে টেকসই করতে ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব হ্রাসে বিভিন্ন পদক্ষেপ এতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।
এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী সমন্বিত প্রযুক্তিগত-অর্থনৈতিক বৃহৎ পরিকল্পনা।
বাংলাদেশ সরকার পানি সম্পদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে এবং জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাব্য প্রভাব প্রশমনে বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ প্রনয়ন ও অনুমোদন করেছে।
বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ এর মিশনটি নিম্নরূপ প্রণয়ন করা হয়েছে:
“জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব কমিয়ে এবং অন্যান্য বদ্বীপ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একটি সমন্বিত ও কার্যকর কৌশল গড়ে তোলার মাধ্যমে ন্যায়সঙ্গতভাবে পানির সুষ্ঠু ব্যবহারে দীর্ঘমেয়াদী স্বাদু পানির প্রাপ্যতা এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং পরিবেশগত স্থায়িত্ব নিশ্চিত করণ।”
এই দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়নের জন্য নির্দিষ্ট লক্ষ্য বা লক্ষ্যগুলি স্থির করা হয়েছে। এতে ২০৪১ সালের প্রেক্ষিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য হ্রাসের পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন ফলাফলগুলিকে একত্রিত করা হয়েছে, জল এবং জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত বিপদ থেকে দীর্ঘমেয়াদী বিরূপ প্রভাব হ্রাস এবং পরিবেশ সংরক্ষণের সাথে লক্ষ্যগুলি স্থির করা হয়েছে।
বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য হল:
৩টি উচ্চ স্তরের জাতীয় লক্ষ্য এবং ৬টি নির্দিষ্ট লক্ষ্য প্রস্তাব করা হয়েছে।
উচ্চ স্তরের লক্ষ্য:
- লক্ষ্য ১: ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য দূর করা;
- লক্ষ্য ২: ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের অবস্থা অর্জন করুন;
- লক্ষ্য ৩: ২০৪১ এর পরে একটি সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তোলা।
বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ নির্দিষ্ট লক্ষ্য:
- লক্ষ্য ১: বন্যা এবং জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত দুর্যোগ থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা;
- লক্ষ্য ২: স্বাদু পানির সুরক্ষা এবং ব্যবহারের দক্ষতা বৃদ্ধি;
- লক্ষ্য ৩: টেকসই এবং সমন্বিত নদী ব্যবস্থা এবং মোহনা ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা;
- লক্ষ্য ৪: জলাভূমি এবং বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ ও রক্ষা করা এবং এদের ব্যবহার উন্নত করা;
- লক্ষ্য ৫: দেশের অভ্যন্তরে এবং সীমান্তে পানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারে কার্যকর সমন্বিত ব্যবস্থাপনায় গড়ে তোলা; এবং
- লক্ষ্য ৬: ভূমি ও পানিসম্পদের সর্বোত্তম ও সমন্বিত ব্যবহার অর্জন করা।
জাতীয় স্তর:
- বন্যা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা;
- স্বাদু পানির প্রাপ্যতা ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনাল।
দুর্যোগ ঝুঁকিপ্রবণ ৬ টি হটস্পট স্তর হলোঃ
- ১. উপকূলীয় অঞ্চলঃ সাইক্লোনপ্রবণ অঞ্চল;
- ২. বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ অঞ্চলঃ খরা (মূলত কৃষি);
- ৩. হাওর এবং আকস্মিক বন্যাপ্রবণ অঞ্চল;
- ৪. পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলঃ পাহাড় ধস ও আকস্মিক বন্যাপ্রবণ অঞ্চল;
- ৫. নদী অঞ্চল এবং মোহনাঃ বন্যাপ্রবণ অঞ্চল;
- ৬. নগরাঞ্চলঃ ভূমিকম্প, জলাবদ্ধতা ইত্যাদি।
ব-দ্বীপ হিসেবে বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ চ্যালেঞ্জসমূহ
- নদী ভাঙ্গন;
- সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং দেশের অভ্যন্তরে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ;
- ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস (মাত্রা/ পরিমাণ ও তীব্রতা বৃদ্ধি);
- ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস (মাত্রা/ পরিমাণ ও তীব্রতা বৃদ্ধি;
- জলাবদ্ধ এলাকা বৃদ্ধি পওয়া;
- পলি জমা ও নদীর নাব্যতা হ্রাস পাওয়া;
- ভূমিকম্প।
বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা–২১০০ এর বিনিয়োগ খরচ এবং অর্থায়নের বিকল্পঃ
বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০, ২০৩০ সাল পর্যন্ত মোট ৮০টি প্রকল্প নিয়ে গঠিত: ৬৫টি ভৌত প্রকল্প, এবং ১৫টি প্রাতিষ্ঠানিক এবং ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রথম পর্যায়ে জ্ঞান উন্নয়ন প্রকল্প।
এর মোট মূলধন বিনিয়োগ খরচ ২৯৭৮ বিলিয়ন টাকা। সমস্ত প্রকল্প আগামী আট বছরের মধ্যে শুরুর পরিকল্পনা করা হয়েছে,
নতুন প্রকল্প এবং নতুন ও পুরাতন প্রকল্পের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মোট বিনিয়োগ প্রয়োজন বার্ষিক জিডিপির প্রায় ২.৫%। বর্তমানে এটি জিডিপির মাত্র 0.৮%।
জিডিপির মোট প্রয়োজনীয় ২.৫% এর মধ্যে, প্রায় ২% সরকারী খাতের মাধ্যমে এব 0.৫% বেসরকারী খাত দ্বারা অর্থায়ন করা যেতে পারে।
যার মধ্যে জিডিপির প্রায় 0.৫% পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রমে এবং অবশিষ্ট ১.৫% নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হবে। এটি লক্ষ্য করা যেতে পারে যে বর্তমানে পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ অত্যন্ত অবহেলিত এবং প্রকৃত পরিমাণ জিডিপির মাত্র ০.১% এর বেশি নয়।
বাংলাদেশ নেদারল্যান্ডস সরকারের সহায়তায় পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নে সহায়তা এবং ফলোআপ করার জন্য ৪ বছরের একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে এবং নিম্নলিখিত প্রকল্পগুলি বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে:
- ৬৪ টি জেলায় খাল ও ছোট নদী খনন ও খনন (প্রথম পর্যায়): মোট প্রকল্প ব্যয় – ২২৭৯.৫৫ কোটি টাকা।
- বাঙ্গালী-করাতোয়া-ফুলজোর-হুরাসাগর নদী ব্যবস্থা এবং নদীর তীর সুরক্ষা প্রকল্পের ড্রেজিং/পূণ: খননপ্রকল্প। মোট ব্যয় ২৩৩৫.৬০ কোটি টাকা।
- নোয়াখালীতে উড়ির চর ক্রস ড্যাম প্রকল্পের মোট ব্যয় ৫৩৩ কোটি টাকা, এখন পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
বিশ্বব্যাংক ইতিমধ্যে এ পরিকল্পনায় অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
বিনিয়োগ অগ্রাধিকারঃ
অগ্রাধিকার ক্ষেত্রগুলি হল- বন্যা সুরক্ষা, নদী ভাঙন নিয়ন্ত্রণ, নদী খনন/পূণঃখনন এবং নাব্যতাসহ নদী ব্যবস্থাপনা, নগর ও গ্রামীণ পানি সরবরাহ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং শহুরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন। এগুলি অত্যন্ত মূলধন-নিবিড় বিনিয়োগ।
প্রথমত, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদী ভাঙন, ড্রেজিং, ট্রেনিং এবং নদ-নদীর নাব্যতাসহ নদী ব্যবস্থাপনা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ খাতে বিনিয়োগ ধরা হয়েছে বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ এর মোট ৩৫%।
দ্বিতীয়ত, বড় শহরগুলিতে শহুরে জল সরবরাহ, স্যানিটেশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং নিষ্কাশনের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ। এ খাতে বিনিয়োগ ধরা হয়েছে বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ এর মোট ২৫% ।
তৃতীয়ত, ছোট শহর এবং গ্রামীণ এলাকায় জল ও স্যানিটেশন পরিষেবার জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহ এবং স্যানিটেশনের জন্য সরকারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ২০৩১ সাল মোট বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ এর বিনিয়োগের ২০% পর্যন্ত ব্যয় করা।
বাঙ্গালী জাতী ছিল আ-জন্ম পরাধীণতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ দাসত্ব জাতী। কখনো এ জাতী বর্গী দ্বারা পীড়িত হয়েছে, কখনও বা পূর্তগ্রীজ, মোগল, ইংরেজ অধিন- ছিল পরাধীন এবং সর্শেষ ছিল পাকিস্তানীদের দাসত্বের অধিনে। বঙ্গবন্ধু এ বাঙ্গালী জাতীকে পরাধীনতার শৃঙ্খল হতে প্রথম মুক্ত করেন/ স্বাধীন করেন, প্রতিষষ্ঠা করেন বাঙ্গালী জাতীর জন্য স্বাধীন একটি রাষ্ট্র – যার নাম বাংলাদেশ।
তারই যোগ্য উত্তরস্বরী আমাদের বর্তমান প্রধামন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রাকৃতিক দূর্যোগ প্রবণ এ ব-দ্বীপ অঞ্চলটির জলবায়ু পরিবর্তণ জনিত বিরূপ প্রভাব মোকাবেলার মাধ্যমে বাঙ্গালী জাতির টিকে থাকা এবং অর্থর্নৈতিক মুক্তির দলিল হিসাবে আগামী ১০০ বছরের দিক নির্দেশণা হলো বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা–২১০০।
বঙ্গবন্ধু বাঙ্গালী জাতীর মুক্তির জন্য প্রাণ দিয়ে গেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট তাঁকে স্বপরিবারে বাঙ্গালী জাতির স্বাধীনতার বিরোধীরা তাঁকে স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে।
১৫ আগষ্ট এর সেই কালো রাত্রির কালো অধ্যায় হতে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর কন্যাদ্বয় বাঙ্গালী জাতীর জন্য বংগবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ বাঙ্গালী জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
২১০০ শতাব্দি অবধি তো শেখ হাসিনা বেঁচে থাকবে না, আমরাও কেহ থাকব না।
কিন্তু আজন্ম, হাজার বছর যে জাতি পরাধীনতার শৃংঙ্খলে আবদ্ধ ছিল যাতে এ দূর্যাগপূর্ণ ব-দ্বীপ অঞ্চলটিতে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব কাটিয়ে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জণের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে স্বাধীন জাতি হিসাবে বাঙ্গালী জাতি যেন মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে থাকতে পারে সে জন্য শেখ হাসিনা ”বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা–২১০০” নামে দিয়েছেন।
যেখানে আমরা বর্তমান ছাড়া ভবিষ্যতের জন্য একবিন্দুও ভাবতে পারি না সেখানে কিনা যখন শেখ হাসিনা বেঁচে এ জাতির আগামী পৃথিবীতে স্বাধীন ও স্বনির্ভর জাতি হিসাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য এ পরিকল্পনা, শত বছরের বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০।
জাতীয় উন্নয়নে এ রকম দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা বিশ্বে বিরল। পরিকল্পনা দেওয়া হয়েছে, ব্যয়ের উৎস দেওয়া হয়েছে, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যয়ের খাত নির্বাচন করা হয়েছে।
ভবিষ্যতে শুধু প্রয়োজন এ মহা পরিকল্পনাটি যুগোপযোগী করা, নকশা করা ও বাস্তবায়ন করা। তবেই জলবায়ুর পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা করে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের মাধ্যমে স্বাধীর সার্বভৌম জাতি হিসাবে ভবিষ্যতে টিকে থাকতে পারবে।