বর্ষায় চলনবিলকে দেখায় অবিকল সমুদ্রসৈকতের মতো
দ্বীপের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট ছোট গ্রাম। গ্রামের কিনারে শিশু–কিশোরদের দাপাদাপি। দর্শনার্থীদের নিয়ে মাঝিমাল্লাদের ছোটাছুটি। মাছ-পাখির লুকোচুরি। বর্ষা যেন চলনবিলে আসার জন্য দর্শনার্থীদের মধুর স্বরে ডাকছে।
অপার চলনবিল প্রায় সময়ই শান্ত। জ্যোৎস্না রাতে খোলা নৌকায় বিহার করলে কানে আসে ঝিঁঝিপোকার সুরেলা মজলিশের ধ্বনি। সেই সুরের জাল ছিঁড়ে যায় মৎস্যজীবীদের হাঁকডাকে।
পাখির কলরব ও গৃহস্থের হাঁসের ডাকাডাকিতে ভোরের আলো ফোটে। তবে আচমকা ঝোড়ো বাতাসে মুহূর্তেই আবার অশান্ত হয়ে উঠতে পারে চলনবিল। নৌকার পাটাতনে আছড়ে পড়া মত্ত ঢেউ দেখে মনে হতে পারে এ এক উত্তাল সমুদ্র।
চলনবিলে পানি ঢুকতে শুরু করে সাধারণত জুলাই মাসে, কমতে শুরু করে অক্টোবরে। এই শুরু আর শেষের সময়ে চলনবিলকে দেখায় অবিকল সমুদ্রসৈকতের মতো। বিলের বুক চিরে গড়া ডুবন্ত সড়কে শীতল পানিতে পা ভিজিয়ে থাকার আনন্দের তখন কোনো সীমা নেই।
চলনবিলের জন্মের দিনক্ষণ নিয়ে জল্পনা অনেক। ইতিহাসবিদেরা বলেন, ব্রহ্মপুত্র নদ তার প্রবাহের পথ বদলে বর্তমান যমুনায় রূপ নেওয়ার সময় দেশের সর্ববৃহৎ এই বিলটির জন্ম হয়।
১৯১৯ সালের ‘ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া’র হিসাবমতে, চলনবিলের আয়তন ১ হাজার ২৯৫ বর্গকিলোমিটার। পলি পড়ে আর নানা অবকাঠামোর চাপে বিলের আয়তন এখন কমে এসেছে।
নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার আটটি উপজেলার ১ হাজার ৬০০ গ্রাম নিয়ে চলনবিলের বিস্তৃতি। বিলের গভীরতম অংশ হচ্ছে নাটোরের সিংড়ার পূর্ব প্রান্ত থেকে সিরাজগঞ্জের তাড়াশের ভদাই নদের পূর্ব পাড় পর্যন্ত।
চলনবিল আসলে বেশ কটি ছোট বিলের সমষ্টি। বর্ষাকালে সব কটি বিল একাকার হয়ে বিরাট জলাশয়ের রূপ নেয়। এটিই চলনবিল।
তখন কোথাও কোথাও এর গভীরতা দাঁড়ায় দুই থেকে চার মিটার পর্যন্ত। এই বিলের মধ্যে রয়েছে ৪৭টি নদী ও অসংখ্য নালা। নদী-নালার উজানের পানির সঙ্গে বিলের পানিও চলতে থাকে বলে এর নাম হয়েছে চলনবিল।
চলনবিল মিঠাপানির মাছের বড় একটা উৎস। মিঠাপানির শুঁটকি মাছের সিংহভাগও উৎপাদিত হয় এখানে। এখানকার মাছের প্রাচুর্য নিয়ে গড়ে উঠেছে পদ্য: ‘মাগুর, টাকি, বাচ্চা বোয়াল, ট্যংরা, ভ্যাদা, ফলি,/ ছড়াৎ ছড়াৎ তৌড়া ফেলে নিচ্ছি ভরে খলি,/ রুই কাতল আর কালবাউশে ভীষণ লাফালাফি, হাজার রকম খুচরা মাছে বোঝাই হলো ঝাঁপি।’
চলনবিল শুধু মৎস্যভান্ডার নয়, শস্যভান্ডারও। শুষ্ক মৌসুমে চলনবিলের বুকজুড়ে ধান, ভুট্টা আর চৈতালি ফসল ফলে। মাইলের পর মাইল ফসলি জমির আইল দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বিলের ঠান্ডা হাওয়া মনে প্রশান্তি জোগায়।
চলনবিলে ঐতিহাসিক স্থাপনা ঘুরে দেখার ব্যবস্থাও রয়েছে। নৌকায় চেপে ঘুরে আসা যায় সিংড়ার হজরত ঘাসি দেওয়ান (রহ.)–এর মাজার, যার পরিচিতি তিসিখালি মাজার নামে।
প্রতিবছর চৈত্র মাসের প্রথম পূর্ণিমায় এখানে মেলা বসে। বর্ষায় যখন চারদিকে পানি আর পানি, তখন মাজারটি একা জেগে থাকে একটি দ্বীপের মতো। প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এখানে বাউলগানের আসর বসে।
চাইলে এখান থেকে দক্ষিণ–পূর্ব কোণে গুরুদাসপুর উপজেলার খুবজিপুরে অবস্থিত চলনবিল জাদুঘরেও ঘুরে আসা যায়। আবদুল হামিদ নামের একজন কলেজশিক্ষক ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠা করেছেন ১৯৭৮ সালে। চলনবিলের নানা নিদর্শন, মাছ ধরার পুরোনো সরঞ্জাম ছাড়াও এখানে আছে বহু দুর্লভ সংগ্রহ।
পাশেই চলবিলের ঐতিহ্যবাহী গ্রাম বিলসা। গ্রামের চারদিকে পানি থই থই করছে। সম্প্রতি নির্মিত বড় সেতুটি গ্রামটিকে উপজেলা সদরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। এই সেতুতে দাঁড়িয়ে প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী বিলের শীতল হওয়ায় মন জুড়ান।
পর্যটকদের জন্য গ্রামটির পাশে একটি কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ করা হয়েছে। দ্বীপের নাম স্বর্ণদ্বীপ। বাঁশের দীর্ঘ সেতু বয়ে সেখানে গিয়ে চা-কফি হাতে নিয়ে বিলের সূর্যাস্ত উপভোগ করা যায়।
নৌকায় চলনবিল ঘুরতে হলে নাটোরের সিংড়া ও বিলদহর, গুরুদাসপুরের বিলসা, পাবনার চাটমহর হয়ে প্রবেশ করা যায়। বাসে বা অটোরিকশায় সুনির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে নৌকা ভাড়া করতে হয়। ঘণ্টায় সারা দিনের জন্য ভাড়ায় পাওয়া যায় ইঞ্জিনচালিত নৌকা। নিরাপত্তার কথা ভেবে লাইফ জ্যাকেটের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।