বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপট টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ (SDG 2030) এর লক্ষ্য সংশোধনের দাবী রাখে
-দীপক কুন্ডু
২০২০ সালটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (Sustainable Development Goal – SDG) এর অগ্রগতি ধারাটি রক্ষা করতে পেরেছে কি?
২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (Sustainable Development Goal – SDG/2030), বা Agenda/2030, বাস্তবায়নকে লক্ষ্য রেখে ২০২০ সালটি ‘নির্ণায়ক দশকের’ প্রথম বছর বলে এ বছরে বেশ কতকগুলো কর্মসূচী ছিল যেমন, খেলাধুলায় স্থিতিশীলতা (Sport Positive Summit 2020), চীনের যুগোপযোগী জীববৈচিত্র্য অনুষ্ঠান (2020 UN Biodiversity Conference), স্কটল্যান্ডের বন্দর নগরী গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বিশাল জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন, COP26।
বিশ্বখ্যাত জলবায়ু দূষণ প্রতিরোধী প্রচারক সুইডিস কিশোরী গ্রেটা থানবার্গ এর ”জলবায়ুর জন্য স্কুল ধর্মঘট(School strike for the climate)বিশ্ব তরুণদের মাঝে ব্যাপক বিক্ষোভ জলবায়ুকে সমস্ত কর্মসূচির শীর্ষে ঠেলে দিয়েছে।
তৎপ্রেক্ষিতে বিশ্বের বড় বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের ১৮১ জন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ঘোষণা করেন যে, শেয়ারহোল্ডার মূল্য তৈরি করা এখন আর কোন কর্পোরেশনের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। এমনকি অর্থের কারবারীদের মধ্যেও উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছিল যেমন, ব্ল্যাকরক (BlackRock) এর প্রতিষ্ঠাতা, চেয়ারম্যান এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ল্যারি ফিঙ্ক উচ্চ কার্বন বিনিয়োগ থেকে বেরিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন (promising to exit high carbon investments)।
যদিও অস্ট্রেলিয়া জুড়ে দাবানল স্বল্প-কার্বন ব্যবস্থা গ্রহণের দাবির সঙ্গে একটি আবেগপূর্ণ তৎপরতা এবং জনগণের ক্ষোভ যুক্ত করেছে। যৌন অসদাচরণের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ওয়াশিংটনে নারীদের যে মিছিল হয় (Me Too and the Women’s Marches) সে স্রোতধারা এবং বেতনের লিঙ্গ বৈষম্য এজেন্ডা ব্যবসা- বানিজ্যে প্রতিধ্বনিত তৈরী করে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) এর জন্য ২০২০ সালটি একটি বড় বছর হতে যাচ্ছিল।
COVID 19 এর প্রাদূর্ভাবে সবকিছু ভেঙে পড়ল।
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারী প্রতিটি পরিকল্পনাকে, এবং আমাদের জীবনের বেশীরভাগ অংশকে উৎখাত করেছে। কোটি মানুষ ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়েছে, এবং এই ভাইরাস সম্ভবত প্রতিটি মানব জীবনকে স্পর্শ করবে।
টেকসই দলের কর্মীবাহিনী এখন স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য জরুরী সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে সার্বক্ষনিকভাবে নিয়োজিত রয়েছে এবং অবিচ্ছিন্নভাবে সংগ্রাম করেছে। ফলে বড় বড় সম্মেলনগুলো বন্ধ হয়ে যায় এবং সাথে সাথে সতর্ক ভাবে পরিকল্পিত কৌশল বাস্তবায়নও থমকে যায়।
অতঃপর লজ্জাজনকভাবে জর্জ ফ্লয়েডের নৃশংস হত্যাকাণ্ড জনগণের চেতনায় এমন দাগ কেটে যায়, যা এর আগে কোনো কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ বা নারীর হত্যা কাণ্ডের ক্ষেত্রে ঘটেনি। কালোদেরও সমাজের সব অধিকার নিয়ে বাঁচার অধিকার রয়েছে (Black Lives Matter) প্রতিবাদ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইইউ, ব্রাজিল, কানাডা, ভারত এবং এর বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে। অন্যায় ও নৃশংসতার একটি ভিন্ন মহামারী অবশেষে আমাদের কাছে দৃশ্যমান হয়ে উঠল, যা আগে আমরা জানতাম, কিন্তু আগে কখনো এতটা সঠিকভাবে বুঝিনি।
এই পৃথিবীতে এখন ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা SDG বাস্তবায়ন অপেক্ষা আরও জটিল সমস্যার সমাধান বাস্তবায়ন জরুরী হয়ে পড়ছে।
মহামারী, বিক্ষোভ, জলবায়ু পরিবর্তন, বৈষম্য, অসত্য তথ্যের বিস্তার, জনপ্রিয়তা এবং জাতীয়তাবাদের উত্থান ইত্যাদি প্রায় এই দশকের নানা চ্যালেঞ্জ। দেখে মনে হচ্ছে যে দৃঢ়সংকল্পের এই দশকে যে, চাপ ও কঠোর সিদ্ধান্তগুলো আমরা আশংকা করেছিলাম (অবশ্য অনেকেই করিনি) তার সবগুলোই যেন সংকুচিত হয়ে এই একটি মাত্র বছরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে।
যে সমস্ত ব্যবসা যথাযথভাবে সম্পন্ন হতে পারে, তাদের কাছ থেকে এই প্রতিটি বিশাল চ্যালেঞ্জ একক মনোনিবেশ এবং বিস্তারিত কৌশলের দাবি রাখে। জলবায়ু পরিবর্তনের মত কিছু বিষয় মোকাবেলার জন্য আমাদের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ প্রয়োজন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বর্ণবাদের ক্ষেত্রে, প্রত্যেক ব্যবসায়ী নেতা আমাদের হৃদয়ের ব্যক্তিগত স্থানগুলোতে পরিদর্শন করুন যেখানে পক্ষপাতিত্ব অদৃশ্য থাকে।
সুতরাং, আমরা কি লক্ষ্যগুলি ছুঁড়ে ফেলে শুধু পরিবর্তনের ঢেউয়ে চড়বো? নাকি ২০৩০ সালের টেকসই লক্ষ্যমাত্রা এই আন্তঃসংযুক্ত, জটিল এবং মারাত্মক জরুরি প্রয়োজন গুলোকে সমাধানে অবদান রাখবো?
অনেকে এখন পরেরটিতেই আস্থা রাখতে চায় । কারণ ২০২০ সালের বিপর্যয়গুলো “ন্যায়বিচার” নামক একটি শব্দের মাধ্যমে উদ্ভাসিত হয়েছে, যা ব্যবসায়ী স¤প্রদায়ের কাছে এলার্জির মতো, এবং তারপরেও “ন্যায়বিচার” পেতে তাদের পারদর্শী হতে হবে।
জলবায়ু ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার, বর্ণবাদী ন্যায়বিচার। ন্যায়বিচারের ধারণা একটি গভীর, ব্যাখ্যামূলক কিন্তু সহজাত ধারণা যা আমরা সবাই প্রথম মুহূর্ত থেকে বুঝতে পারি যখন আমরা শিশু হিসেবে ‘ন্যায্যতা’ দাবি করি।
কিন্তু যদি ২০৩০ সালের মধ্যে ন্যায়বিচার টেকসইতার ক্ষেত্রে পরিমাপক হয়ে ওঠে, তাহলে আমাদের অবশ্যই ধারণা থেকে মূর্ততার দিকে এগিয়ে যেতে হবে। পরিবেশ ও সামাজিক শাসন ব্যবস্থাকে (Environmental and Social Governance or ‘ESG’) পরিবেশ ও সামাজিক ন্যায়বিচার (Environmental and Social Justice or ‘ESJ’)-এ উন্নীত করার বিষয়টিতে সকলের বেশী গুরুত্ব দেওয়ার সময় এখন।
এসডিজি ১৬: শান্তি ও ন্যায়বিচার (SDG Goal 16: Peace, justice and strong institutions – “Promote peaceful and inclusive societies for sustainable development, provide access to justice for all and build effective, accountable and inclusive institutions at all levels.”) বর্তমানে যা ব্যবসার ক্ষেত্রে উপেক্ষিত, যা ছাঁকনির মত ব্যবহার করে অন্য সব ব্যবসার লক্ষ্যসমূহ পর্যবেক্ষণ করা যাবে।
বিশেষত ২০৩০ খ্রিস্টাব্দের জাতিসংঘের লক্ষ্যমাত্রার পরিপ্রেক্ষিতে “সকল পর্যায়ে সংবেদনশীল, সমন্বিত, অংশগ্রহণমূলক এবং প্রতিনিধিত্বমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ নিশ্চিত করা”।
এই সমস্ত কর্পোরেটের নিজেদের ২০৩০ লক্ষ্য কি হবে? শূন্য মাত্রার কার্বনে যাওয়ার প্রতিশ্রæতি, নেতৃতের¡ ৫০% নারীর কাছে পৌঁছানো অথবা উৎপাদকের পণ্যের উপর একটি নতুন সবুজ লেবেল চালু করার প্রতিশ্রæতি – যার বাস্তবায়ন এখন এই স্বল্প সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না বলে মনে হচ্ছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (SDG) এর মধ্যে নিন্মোক্ত প্রতিশ্রুতিগুলির কাঠামোর মধ্যে পুনর্বিবেচনা করবার কথা ভাবতে পারা যায়:
- জলবায়ু ন্যায়বিচার – জলবায়ু অভিযোজনে বিনিয়োগ, জীবাশ্ম জ্বালানী (ডিজেল, পেট্রোল, অকটেন ইত্যাদি) থেকে সরে এসে একটি ‘সম্পূর্ণ বিকল্প’-এর চিন্তা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অসম প্রভাব দূর করতে কাজ করার পরিকল্পনা।
- জাতিগত এবং আন্তঃব্যবধানের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার – সমান বেতন এবং সমান প্রতিনিধিত্বমূলক লক্ষ্যমাত্রার গভীরে দৃষ্টি প্রদান, এবং কোনো সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্তি শুধুমাত্র বৈচিত্র্যের সংখ্যার হিসাবে পরিমাপ না করে বরং উৎস ও স্বত্বের ক্ষেত্রে সংহতির বিষয়টি লক্ষ্য করা।
- জাতিগত এবং আন্তঃব্যবধানের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার – সমান বেতন এবং সমান প্রতিনিধিত্বমূলক লক্ষ্যমাত্রার গভীরে দৃষ্টি প্রদান, এবং কোনো সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্তি শুধুমাত্র বৈচিত্র্যের সংখ্যার হিসাবে পরিমাপ না করে বরং উৎস ও স্বত্বের ক্ষেত্রে সংহতির বিষয়টি লক্ষ্য করা।
- সততা এবং স্বচ্ছতা, পক্ষপাতিত্ব, নীতি এবং প্রভাব – প্রতিটি ক্ষেত্রে কাজের শর্ত ও ধরনের উপর প্রত্যেকটি সুনির্দিষ্ট পণ্য সম্পর্কে ভোক্তাদের সাথে সৎ থাকা।
- পুনরুদ্ধার – যে বাস্তুতন্ত্র (ecosystems) এর উপর নির্ভর করে এবং যার ভিতরে থেকে কৃষি এবং স্থল বা সমুদ্র থেকে সম্পদ আহরণ করা হয় তা পুনরুদ্ধার, এবং এমনকি শোষিত/অবহেলিত সম্প্রদায়ের পুনর্জাগরণ প্রয়োজন।
This Article is written in Bangla by following the “Your 2030 Sustainability Targets Are Wrong” by Solitaire Townsend for Probes.