ভারতে অস্বাভাবিক বৃষ্টির কারণে গঙ্গার পানি বেড়ে যাওয়ায় হঠাৎ বন্যার কবলে পড়েছে বাংলাদেশের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, পাবনা, কুষ্টিয়া, মাগুরা, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর জেলাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা।ফলে বন্যাকবলিত এলাকায় পানীয়জল ও বর্জ্য পদার্থ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ নোংরা ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি ভেঙে চলাচল করছে।
বন্যার পানিতে বংশবিস্তার করছে হাজার হাজার রোগজীবাণু। বিশুদ্ধ পানির অভাবে মানুষ যখন এই দূষিত পানি পান করছে কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করছে, তখন তারা আক্রান্ত হয়ে পড়ছে নানা ধরনের অসুখ-বিসুখে। ছড়িয়ে পড়ছে ডায়রিয়া, আমাশয়সহ বিভিন্ন আন্ত্রিক রোগ।

এ ব্যাপারে বেসরকারি আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেলের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক কাওসার আহমেদ বলেন, বন্যার পানি বাড়িঘরে ওঠার পর এবং পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পানিবাহিত নানা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। বিশুদ্ধ পানির অভাবে পানিবাহিত নানা রোগ যেমন ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়, টাইফয়েড, পেটের পীড়া, কৃমির সংক্রমণ, চর্মরোগ প্রভৃতি দেখা দেয়। এ জন্য বন্যায় আক্রান্ত মানুষের স্বাস্থ্য সচেতন থাকা খুবই প্রয়োজন।
এসব সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো মেনে চলা একান্ত প্রয়োজন-
নিশ্চিত করতে হবে বিশুদ্ধ পানি
বন্যাকবলিত এলাকায় শুধু বিশুদ্ধ পানির অভাবে বিস্তার লাভ করে পানিবাহিত রোগগুলো। ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস, কৃমির সংক্রমণ দেখা দেয় মহামারী হিসেবে। ডায়রিয়ার কারণে মৃত্যু ঘটে অনেকের।বন্যায় প্রথমেই পানির বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। পানিকে বিশুদ্ধ করে খাওয়া ও দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করতে পারলে এসব রোগের হাত থেকে বাঁচা সম্ভব হবে।বিশুদ্ধ পানির ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য পানি ভালোমতো ফুটিয়ে নিতে হবে। পানি ফুটিয়ে ঠান্ডা করে তার পর পান করতে হবে এবং সব কাজে ব্যবহার করতে হবে।পানি ফুটানোর ব্যবস্থা না থাকলে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ব্যবহার করতে হবে। প্রতি দেড় লিটার খাবার পানিতে ৭ দশমিক ৫ মিলিগ্রাম হ্যালোজেন ট্যাবলেট (হ্যালো ট্যাব), তিন লিটার পানিতে ১৫ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট এবং ১০ লিটার পানিতে ৫০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা রেখে দিলে পানি বিশুদ্ধ হয়।তবে এতে অন্যান্য জীবাণু মরলেও ভাইরাসজাতীয় জীবাণু মরে না। একমাত্র টগবগিয়ে পানি ফুটানোর ফলে ভাইরাস জীবাণু ধ্বংস হয়।
দূরে থাকতে হবে বন্যার পানি থেকে
বন্যার পানিতে হাঁটা কিংবা পানি শরীরে লাগানো স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বন্যার পানিতে গোসল করা, কাপড়চোপড় ধোয়া কিংবা থালাবাসন পরিষ্কার করা কোনোটাই চলবে না। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের বন্যার পানির সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখতে হবে।বন্যার পানি দিয়ে কখনো কেউ যেন হাত-মুখ না ধোয় এবং কুলি না করে, সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।
ব্যবস্থা নিতে হবে ডায়রিয়া প্রতিরোধে
বন্যায় প্রধান স্বাস্থ্য সমস্যা হলো ডায়রিয়া। ডায়রিয়া প্রতিরোধের জন্য খাবার আগে সাবান দিয়ে নিরাপদ পানির সাহায্যে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিতে হবে। পায়খানা করার পর হাত একইভাবে পরিষ্কার করতে হবে। স্যানিটারি পায়খানা বা জলাবদ্ধ পায়খানা ব্যবহার করতে হবে। ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা শুরু হলে পরিমাণমতো খাবার স্যালাইন খেতে হবে। দুই বছরের কম শিশুকে প্রতিবার পাতলা পায়খানার পর ১০-১২ চা চামচ খাবার স্যালাইন দিতে হবে। ২ থেকে ১০ বছরের শিশুকে দিতে হবে ২০ থেকে ৪০ চা চামচ। ১০ বছরের বেশি বয়সী শিশুকে দিতে হবে যতটা বেশি দেওয়া যায়। খাবার স্যালাইন বা ওআরএস না থাকলে বিকল্প হিসেবে বাড়িতে প্রস্তুতকৃত লবণ-গুড়ের শরবত খাওয়াতে হবে। এর সঙ্গে ভাতের মাড়, চিড়ার পানি, ডাবের পানি, কিছু পাওয়া না গেলে শুধু নিরাপদ পানি খাওয়ানো যেতে পারে। এ সময় যাতে শিশুর পুষ্টিহীনতা না হয়, সে জন্য খিচুড়ি খাওয়ানো প্রয়োজন।যদি পাতলা পায়খানা ও বমির মাত্রা বেড়ে যায়, তাহলে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
সতর্ক হতে হবে খাবার গ্রহণে
বন্যায় পচা-বাসি খাবার খেতে বাধ্য হয় অসংখ্য মানুষ। এর ফলে ছড়িয়ে পড়ে ডায়রিয়াসহ অন্যান্য আন্ত্রিক রোগ। কিন্তু এ সময়ে খাবার গ্রহণে সতর্ক হতে হবে। বাসি-পচা খাবার খাওয়া যাবে না। রাস্তার পাশ থেকে ফুসকা বা চটপটি খাওয়া একেবারেই বন্ধ করতে হবে। এ সময় খিচুড়ি খাওয়া স্বাস্থ্যোপযোগী। খাওয়ার আগে ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে হবে। খাবার প্লেটও সাবান ও নিরাপদ পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে।
সতর্ক হতে হবে মলত্যাগে
বন্যার সময় মলত্যাগে সতর্কতা অবলম্বন করা খুবই জরুরি। যেখানে সেখানে মলত্যাগ করা চলবে না। যেখানে সেখানে মলত্যাগ করার ফলে পেটের পীড়া তো রয়েছেই, উপরন্তু কৃমির সংক্রমণ বেড়ে যায়। একটি নির্দিষ্ট স্থানে মলত্যাগ করতে হবে এবং মলত্যাগের পরে সাবান বা ছাই দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। মলত্যাগের সময় কখনো খালি পায়ে থাকা চলবে না, কেননা বক্রকৃমির জীবাণু খালি পায়ের পাতার ভেতর দিয়ে শরীরে সংক্রমিত হয়। এ সময় বাসার সবাইকে কৃমির ওষুধ খেতে হবে। দুই বছর বয়সের নিচের শিশুদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
সাবধান থাকতে হবে আকস্মিক দুর্ঘটনা থেকে
বন্যার কারণে যেমন রোগের বিস্তার বৃদ্ধি পায়, তেমনি দেখা দেয় আকস্মিক দুর্ঘটনা। কেবল প্রাথমিক চিকিৎসা ও সতর্কতার মাধ্যমে এসব দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। বন্যায় সাধারণত বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা, পানিতে ডুবে যাওয়া, সাপ ও পোকামাকড়ের কামড়ের ঘটনাগুলো বেশি ঘটে। বন্যায় পানির নিচে বহু টাওয়ার, খুঁটি, ট্রান্সফরমার লাইনের তার ডুবে যায়। তাই বৈদ্যুতিক লাইনের নিচ দিয়ে নৌকা বা ভেলা চালানো যাবে না অথবা বিদ্যুতের টাওয়ার, খুঁটি, তার বা ট্রান্সফরমার স্পর্শ করা যাবে না। বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে গেলে বা পড়ে থাকতে দেখলে তা স্পর্শ না করে বিদ্যুৎকর্মীদের জরুরিভাবে খবর দিতে হবে। বৈদ্যুতিক লাইনের তার কোথাও পানির কাছাকাছি দেখামাত্র সেখান থেকে দূরে সরে যেতে হবে এবং দ্রুত নিকটস্থ বিদ্যুৎ অফিসে খবর দিতে হবে।