প্লাস্টিক দূষণ রোধে দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বব্যাপী চলছে লড়াই
পরিবেশে প্লাস্টিক দূষণ বন্ধে আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি করতে গত প্রায় দুই বছর ধরে আলোচনা চলছে। জাতিসংঘের প্লাস্টিক দূষণ সংক্রান্ত আন্তঃসরকারি আলোচনা কমিটি এই আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
কানাডার অটোয়াতে গত সপ্তাহে শেষ হয়েছে সেই আলোচনার চতুর্থ রাউন্ড। এবারের আলোচনায় ১৭৫টি দেশের আলোচকদের মধ্যে মতবিরোধের প্রধান বিষয় ছিল প্লাস্টিকের উৎপাদন বন্ধ করা নিয়ে।
অনেক দেশই তা করতে রাজি হচ্ছে না। প্লাস্টিকের বেশিরভাগই জীবাশ্ম জ্বালানি ও নানা বিষাক্ত রাসায়নিক থেকে তৈরি হয়, যা ব্যবহারের পরেও পরিবেশ দূষণ করে। কারণ এটি সহজে বা সম্পূর্ণভাবে পঁচে না। তাই প্লাস্টিক দূষণ রোধে দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্বব্যাপী লড়াই চলছে।
সেই লড়াইয়ের ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালের মার্চে জাতিসংঘের পরিবেশ পরিষদ (ইউএনইএ) প্লাস্টিক দূষণ বন্ধে আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক একটি চুক্তি করার সিদ্ধান্ত নেয়।
এ জন্য ১৭৫টি দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি আন্তঃসরকারি আলোচনা কমিটি গঠন করা হয়। ২০২৪ সালের মধ্যেই একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর লক্ষ্যে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে ওই কমিটি।
২০২২ সালের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ওই কমিটি আলোচনা শুরু করে। প্রথম তিন রাউন্ডের আলোচনা হয় উরুগুয়ে ফ্রান্স ও কেনিয়ায়। চতুর্থ রাউন্ডের আলোচনা হল কানাডায়।
কিন্তু চার দফা আলোচনার পরও প্লাস্টিক সমস্যা সমাধানে চূড়ান্ত কোনও রূপরেখা তৈরি করতে পারেনি ওই কমিটি। চলতি বছরের শেষ দিকে (নভেম্বর-ডিসেম্বরে) দক্ষিণ কোরিয়ায় চূড়ান্ত পর্বের আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।
একমাত্র যুক্তরাজ্য গত মাসে বলেছিল, প্লাস্টিকযুক্ত ভেজা টিস্যু নিষিদ্ধ করার জন্য তারা আইন করবে। প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি ভেজা টিস্যুগুলো ব্যবহারের পর সেগুলো থেকেও পরিবেশে ক্ষতিকারক মাইক্রোপ্লাস্টিক ছড়ায়।
আমরা জানি যে, প্লাস্টিকের ব্যাগ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু আমরা যেটা জানি না, তা হল আমাদের নিত্য ব্যবহার্য্য আরও অনেক জিনিসেই অদৃশ্য প্লাস্টিক বা মাইক্রোপ্লাস্টিক থাকে, যা আমরা দেখতে পাই না। ফলে শুধু প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ করলেই প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ হবে না।
অদৃশ্য প্লাস্টিক এবং মাইক্রোপ্লাস্টিক কী
এমন অনেক জিনিস আছে যেগুলোকে আপাতদৃষ্টিতে প্লাস্টিকের তৈরি বলে মনে হয় না, কিন্তু ব্যবহারের পর সেগুলো থেকেও পরিবেশে প্লাস্টিক ছড়ায়। তাদের একটি ওয়েট ওয়াইপস বা ভেজা টিস্যু।
কানাডার ডালহৌসি ইউনিভার্সিটির স্কুল ফর রিসোর্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজের অধ্যাপক টনি ওয়াকার বলেন, ‘অদৃশ্য প্লাস্টিক সর্বত্রই রয়েছে। আমাদের চেয়ার, টেবিল ও কম্পিউটার থেকে শুরু করে নিত্য ব্যবহার্য্য বেশিরভাগ জিনিসেই কোনও না কোনও ধরনের প্লাস্টিক রয়েছে।’
তবে তার মতে, সমস্ত প্লাস্টিক বাদ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। উদারহণস্বরূপ, আসবাবপত্র তৈরিতে ব্যবহৃত প্লাস্টিক। কারণ আসবাবপত্র আমরা দশকের পর দশক বা দীর্ঘকাল ধরে ব্যবহার করি। ফলে সহসাই এর পরিবেশ দূষণে অবদান রাখার সম্ভাবনা নেই।
তিনি বলেন, একবার ব্যবহারযোগ্য যেসব জিনিসে প্লাস্টিক আছে আমাদেরকে বরং সেগুলো কমানো বা বাদ দেওয়ার প্রতি বেশি মনোযোগ দিতে হবে। এগুলো আমাদের আবর্জনার ভাগাড়ে হাজার হাজার টন প্লাস্টিক যোগ করছে। এসব থেকেই পরিবেশে মারাত্মক ক্ষতিকর মাইক্রোপ্লাস্টিক ছড়ায়।
মাইক্রোপ্লাস্টিক হল প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা, যা এমনকি আমাদের খাদ্যেও প্রবেশ করতে পারে। যেমন সমুদ্রের পানিতে প্লাস্টিক কণা মিশলে তা মাছের পেটে চলে যায়। আর সেই মাছ খেলে তা আমাদের দেহের রক্তেও মিশে যেতে পারে।
২০২২ সালে প্রথম বিজ্ঞানীদের গবেষণায় ধরা পড়ে, মানুষের রক্তেও মাইক্রোপ্লাস্টিক বা প্লাস্টিক কণা ঢুকে পড়েছে। রক্তে থাকা ০.০০০৭ মিলিমিটার পর্যন্ত ছোট প্লাস্টিক কণাও শনাক্ত করা গেছে।
এনভায়রনমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল সাময়িকীতে প্রকাশিত ওই গবেষণার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গবেষণায় প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষের রক্তে প্লাস্টিক কণার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। অনেকের রক্তে একাধিক ধরনের প্লাস্টিক কণা পাওয়া গেছে।
ওই গবেষণার অর্থায়ন করেছিল ডাচ ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর হেলথ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কমন সিজ। সংস্থাটি প্লাস্টিক দূষণ কমাতে কাজ করা একটি সামাজিক উদ্যোগ।
এরপর যুক্তরাজ্য সরকার ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও মানব স্বাস্থ্যের ওপর প্লাস্টিক দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে গবেষণা শুরু করে।
অধ্যাপক টনি ওয়াকার বলেন, এমনকি তথাকথিত ‘বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক’ বা যা একবার ব্যবহারের পর পঁচনযোগ্য বা প্রাকৃতিকভাবে ভেঙে যেতে সক্ষম বলে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়, তাতেও মাইক্রোপ্লাস্টিক থাকতে পারে।