প্রাকৃতিক পরিবেশের অবস্থা ভয়াবহ
রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত পরিবেশের যত ধরনের সর্বনাশ রয়েছে, তার কোনোটা আর তেমন বাদ নেই। বিশ্বের সবচেয়ে বিষাক্ত বা নিন্ম মানের বাতাসের নগরীর তালিকার শীর্ষস্থানে বারবার উঠে আসছে ঢাকার নাম।
নিরিবিলি পল্লীর বাতাসও যে নির্মল সেই দাবি করার অবস্থা নেই। নদী-নালা, খাল-বিল, জনপদ মিলিয়ে গ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশের অবস্থাও গুরুতর। করোনা, কলেরা থেকে যক্ষা, ক্যান্সারের মতো রোগবালাই ছড়ানোর যত উপাদান থাকে, তার সবই এতে বিদ্যমান।
বন্যা-খরা, ঝড়-তাপদাহের যাবতীয় কারণও বাদ নেই। ভূমিকম্পের মতো সর্বনাশের শঙ্কাও জোরদার এই পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে। কিন্তু, দিব্যি এর দায় চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে প্রকৃতির ওপর। বলা হচ্ছে, প্রকৃতি ক্ষেপে গেছে, প্রকৃতি পাল্টে গেছে। প্রকারান্তরে স্রষ্টাকেও দোষী করে দেয়া হচ্ছে ‘খোদার গজব’ বলে দায়ী করে।
এর মধ্য দিয়ে পরিবেশ বিপর্যয় ও প্রাকৃতিক লীলার পেছনে মানুষের অপকর্মকে আড়াল করে দেয়া হচ্ছে। হোক তা বুঝে, নইলে না বুঝে। এমনিতেই বাংলাদেশ ভূমিকম্পন প্রবণ। বিভিন্ন গবেষণায় এসেছে, মোটা দাগে তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান।
পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ভারত প্লেট, উত্তরে তিব্বত উপপ্লেট এবং পূর্বে ও দক্ষিণ-পূর্বে বার্মা উপপ্লেট। ভারত ও বার্মা প্লেটের সংযোগ বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে গেছে। পূর্ব অংশটি বার্মা প্লেট এবং পশ্চিমাংশ ভারতীয় প্লেটের মধ্যে।
ভূতাত্ত্বিক গঠন এবং টেকটোনিক এ কাঠামোর কারণে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ভূমিকম্পের মারাত্মক ঝুঁকিতে। বঙ্গবন্ধু সেতুর আশপাশে এবং নোয়াখালীতে এ রকম ফল্ট লাইন আছে। লাইনগুলোর বিস্তার শত শত মাইল। তাই এসব ফল্ট লাইন ও আশপাশ খালি রাখতে হয়।
অথচ নিয়মনীতি না মেনে এসব ফাটল বা লাইনে যথেচ্ছা বাড়ি, ভবনসহ কত স্থাপনা হচ্ছে। তাও গাদাগাদি করে, ৩ তলার ভিত্তিতে ৭-৮ তলা। এছাড়া নদী-খাল প্লাস্টিক মেশানো মাটি ভরাট করে বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে অহরহ, যা ভূমিকম্পকে ডেকে আনার পথপরিক্রমা তৈরি করছে।
গ্রামকে শহর বানিয়ে ফেলার আয়োজনের মাঝেও চলছে সর্বনাশা খেলা। বন্যা, খরা, ভূমিকম্পের নানা আয়োজন সেখানে। এ নগরায়ণে ভূ-ভাগের অবস্থান, ফল্ট লাইন দেখা, মাটির প্রকৃতি, ভূমিতলের উচ্চতা, ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য কিছুই গুরুত্ব পাচ্ছে না। জলাশয়-জলাভূমি ভরাট করে আবাসন ও অবকাঠামো নির্মাণের সময় এসব ভাবাই হচ্ছে না।
ঢাকার ভূমিতলের উচ্চতা ৫-১৮ মিটারের বেশি নয়। এ অঞ্চলের অনেক জায়গায় ভবন নির্মাণ ও নগরায়ণের জন্য উপযোগী লাল মাটি বিদ্যমান আছে। আবার অনেক এলাকায় প্রাকৃতিকভাবেই নিচুভূমি, জলাশয় ও ভূ-অভ্যন্তরে পানি ধারণ অঞ্চল বা একুইফার আছে।
এসব শনাক্ত বা বিবেচনার কোনো বালাই নেই। ১৯৯৬ সাল থেকে দেশে বিল্ডিং কোড আছে, আবার তা না মানার ব্যবস্থাও আছে। তা যে প্রকৃতির স্বাভাবিকতায় কী গণ্ডগোল পাকাচ্ছে, এটি বুঝতে খুব বিশেষজ্ঞ হওয়া জরুরি নয়। প্রকৃতির প্রতিশোধের শিকার হয়ে যাচ্ছে সবাই। প্রতিশোধের সময় প্রকৃতি নিরপেক্ষভাবে সবাইকে এক পাল্লায় ফেলছে।
রাজধানী ঢাকাকে ব্যবহার করে নিজেদের আখের গোছানোর মাঝে এ বোধ জাগে না। বাসযোগ্যতা নষ্ট করে সুন্দর নাগরিক জীবন আশা করায় কিন্তু কমতি নেই। বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, নদী-খাল দূষণ, প্লাস্টিক-পলিথিন দূষণ, পানিদূষণ, বর্জ্যদূষণ, জলাবদ্ধতাসহ বিভিন্ন পরিবেশগত সমস্যায় ঢাকাকে জর্জরিত করতে কারো চেয়ে কেউ পিছিয়ে থাকছে না।
নগরীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যার দখল-দূষণে আধমরা করে দেয়া হয়েছে কবেই। শহরের অভ্যন্তরের খালগুলো ভূগোলে নেই। ঠেলে দেয়া হয়েছে ইতিহাসে। একসময় ঢাকা শহরের ভেতরে ৫৪টিরও বেশি খাল ছিল। এখন ২৩টির কথা বলা হলেও গুনলে পাওয়া যায় না।
অন্যান্য বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোর অবস্থাও শোচনীয়। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের পাহাড়ি সৌন্দর্য এখন কেবলই কথার কথা। সেখানে নানান পাহাড়ের কথা কাগজে আছে, বাস্তবে নেই। চার দশকে চট্টগ্রামের ছোট-বড় শতাধিক পাহাড় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পাহাড়গুলো নিজে নিজে বিলুপ্ত হয়নি। রাতবিরাতে কোথাও চলে যায়নি।
সেখানে পাহাড়খোর আছে। এদের পেটে গেছে পাহাড়গুলো। এক হিসাবে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মহানগরীতে ৪০ বছর আগে পাহাড় ছিল ২০০টি, যার ৬০ শতাংশ ‘নাই’ করে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিডিএ ১৫টি পাহাড় কেটে ফৌজদারহাট-বায়েজিদ বাইপাস সড়ক নির্মাণ করেছে।
স্বাধীনতার পর ২০০৮ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের ৮৮টি পাহাড় পুরোটাই বিলুপ্ত হয়েছে। একই সময়ে আংশিক কাটা হয়েছে ৯৫টি। এরপরের ১২ বছরে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার নিয়েছে। শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পাহাড় নিধন। জঙ্গল সলিমপুরসহ চট্টগ্রামের বাদবাকি পাহাড়গুলোর দিকেও অনেকের কুনজর।
জনপ্রতিনিধি নামের কিছু দানবও আছে এই পালে। এদের রয়েছে নিজস্ব পেটোয়া বাহিনী। জঙ্গল সলিমপুর এলাকার এক ওয়ার্ড কমিশনার এ কর্মের মাফিয়া হিসেবে পরিচিত। এই পাহাড়খেকোরা ভীষণ শক্তিধর-পরাক্রমশালী।
কেবল সৌন্দর্য নয়, চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষাকারী পাহাড়গুলো প্রতিনিয়ত কেটে কেটে নিচ্ছে এরা। সেখানে দেশের অন্যতম প্রধান নদী কর্ণফুলী, হালদা, সাংগু নদীও দখল, দূষণ, ভরাট, চর জাগা এবং পরিকল্পিত ড্রেজিং না করায় ভয়াবহ হুমকির মুখে।
শহরের অতি নিকটে জঙ্গল সলিমপুর ও আলিনগর এলাকা। এখানে সরকারের খাস খতিয়ানভুক্ত পাহাড় ছিল ৩ হাজার ১০০ একর। কিন্তু গত দুই যুগের মধ্যে ৪০ থেকে ৫০ জনের চিহ্নিত ভূমিদস্যু বাহিনী চট্টগ্রামের এই জঙ্গল সলিমপুর ও আলিনগর এলাকার পাহাড় কেটে আলাদা এক সাম্রাজ্য তৈরি করেছে।
গড়ে তুলেছে দেশের ভেতরে আরেক দেশ। তাদের সহযোগী হিসেবে আছেন আরও অন্তত ৩০০ জন দখলদার বাহিনী। এই ভূমিদস্যুরা ২০০০ সাল থেকে যখন যে দল ক্ষমতায় ছিল, তখন সে দলের ব্যানার টাঙিয়ে নিজেদের সাম্রাজ্য পোক্ত করেছে।
তারা প্রতিনিয়ত সরকারে খাস খতিয়ানভুক্ত পাহাড় কেটে প্লট বানিয়ে হাজার হাজার ছিন্নমূল মানুষের কাছে ভাড়া কিংবা দখল বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতানোর সনদধারী যেন এরা। যে শক্তিতে এরা ছড়িয়ে পড়েছে চট্টগ্রাম নগরের বাইরেও। কক্সবাজার, চকরিয়া এবং জেলার বিভিন্ন উপজেলায় পাহাড় কাটা তাদের বাণিজ্য।
পাহাড় ধসলে বা অন্য কোনো কারণে প্রশাসন থেকে মাঝেমধ্যে পাহাড় ঘেঁষে বসবাসকারীদের তাড়ানো হয়। কিন্তু তাদের সেখানে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করে দেয়া পাহাড়খেকোদের পার পাইয়ে দেয়ার বহু অভিযোগ রয়েছে। এ সম্মিলিত অপকর্মের জের সইছে চট্টগ্রামের প্রকৃতি।
এছাড়া পাহাড় কেটে বসতি গড়ে তোলা পাহাড়ধসের মূল কারণ। নাসির খাল, চাক্তাই খালসহ প্রায় ৫০ এর বেশি খাল দখল করে করে ভরাট করা হয়েছে। ফলে একটু বৃষ্টি হলেই ডুবে যায় চট্টগ্রাম। তা জেনে-বুঝেই নানান কথায় ঢেকে দেয়া হচ্ছে সমস্যার মূল কারণটি।
বিভাগীয় আরেক জেলা পূণ্যভূমি সিলেট নগরীর প্রকৃতিও নড়বড়ে। দখল-ভরাটে সর্বনাশ করে দেয়া হয়েছে শহরটির প্রাণ বলে পরিচিত অর্ধশতাধিক জলাশয় ও খাল। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন- বাপার হিসাবে, সিলেটে পুকুর-দিঘি মিলিয়ে জলাশয় ছিল ৩ শতাধিক। এর দুই-তৃতীয়াংশই ভরাট হয়ে গেছে।
অনেক জলাশয় ভরাট করে সরকারি প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে। এছাড়া সিলেটের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ছোট-বড় প্রায় ২৫টি প্রাকৃতিক খাল। স্থানীয়ভাবে এগুলোকে বলা হয় ‘ছড়া’ । পাহাড় বা টিলার পাদদেশ থেকে উৎপত্তি হয়ে ছড়াগুলো গিয়ে মিশেছে সুরমা নদীতে। এসব ছড়া দিয়েই বর্ষায় পানি নিষ্কাশন হতো।
এসব ‘ছড়া’ খেয়ে ফেলায় অল্প বৃষ্টিতেই ডুবে যায় সিলেট নগরীসহ আশপাশ। সিলেট-সুনামগঞ্জসহ ওই অঞ্চলে দফায়-দফায় আগাম ও দীর্ঘ বন্যার পেছনে ছড়াসহ জলাশয় মেরে ফেলাও অন্যতম কারণ। আগে ছড়াসহ বেশ কিছু জলাভূমিতে বন্যার পানি থেকে যেতে পারত। কিন্তু এখন তা হচ্ছে না।
বাংলাদেশের জন্ম নদীর পানিপ্রবাহের ওপর। নদী বিপন্নের সমান্তরালে এখন বাংলাদেশের প্রাকৃতিক অস্তিত্বই বিপন্নের পথে। নদী হারানোর সর্বনাশ এক-দুই বছরে, এক-দুই দশকে বোঝা যায় না। ভারত-বাংলাদেশের অভিন্ন ৫৪টি নদীর সঙ্গে সম্পর্কিত ছোট নদী, শাখা নদীর সংখ্যা বাংলাদেশে আগে ছিল সহস্রাধিক।
এখন কোনো মতে বেঁচে আছে দুই শতাধিক। দখল-দূষণসহ একতরফা অবিরাম আক্রমণে দেশের অসংখ্য ছোট নদী এখন একেকটি মৃতদেহ। এর পরিণামও ভুগছে বাংলাদেশ। ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মা নদীর বড় অংশ এখন শুকিয়ে গেছে। ভারসাম্যহীন পানিপ্রবাহে ক্ষতিগ্রস্ত উত্তরবঙ্গের বিশাল অঞ্চলের কৃষি।
সেচের জন্য চাপ বাড়ছে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর, যা দীর্ঘমেয়াদে আরও জটিল পরিস্থিতি তৈরি করছে। তা দুর্বল করে চলছে সংযুক্ত নদীগুলোকেও। এই প্রভাব গিয়ে পড়েছে সুন্দরবন পর্যন্ত। সুন্দরবনের কাছে নদীর প্রবাহ দুর্বল হয়ে যাওয়ায় লবণাক্ততা বেড়েছে, তাতে ক্রমাগত ক্ষয়ের শিকার হচ্ছে বনের জীবনসহ দেশের সামগ্রিক প্রকৃতির রুক্ষতা।