প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে রূপ বদলাচ্ছে সুন্দরবন
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সুন্দরবনের পরিবেশগত ঝুঁকি বাড়ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ উঁচু হয়ে যাওয়ায় নোনা পানি প্রবেশ করছে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে। সেই সঙ্গে উজানের প্রবাহ কমে যাওয়ায় জোয়ারের পানিতে ভেসে আসা পলি জমছে নদী-খাল ও বনভূমিতে।
লবণাক্ততার প্রভাবে এরই মধ্যে বনের বিভিন্ন অংশে সুন্দরী গাছের আধিক্য কমেছে। সেখানে জায়গা নিয়েছে লবণসহিষ্ণু গরান ও কাঁকড়াজাতীয় গাছ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে রূপ বদলাচ্ছে সুন্দরবন। কয়েক বছরে বনের কাছাকাছি নদী-সমুদ্রে জেগে ওঠা বনভূমিতে জন্ম নেওয়া ম্যানগ্রোভ জাতীয় গাছ দ্রুত বেড়ে উঠেছে। তবে মূল বনভূমিতে গাছের সংখ্যা তুলনামূলক বাড়েনি।
বন কর্মকর্তারা বলছেন, সিডর-আইলার মতো দুর্যোগে বনের যে ক্ষতি হয়েছিল, তা প্রাকৃতিকভাবেই পুষিয়ে নেওয়া গেছে। গাছের আগামরা রোগও আগের তুলনায় কমেছে। বর্তমানে সুন্দরবনে উদ্ভিদের মধ্যে ৭০ শতাংশই হচ্ছে সুন্দরী, গেওয়া ও গরানগাছ।
তবে এসব উদ্ভিদের মধ্যে বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় থাকা পাঁচ প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে লাহুর, বনবকুল, মহাজনি লাতা ও দুই প্রজাতির অর্কিড।
২০২০ সালে বিশ্বব্যাংক এক প্রতিবেদনে সুন্দরবনের আয়তন কমে যাওয়ার কিছু তথ্য প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯০৪ সালে সুন্দরবনের আয়তন ছিল ১১ হাজার ৯০৪ বর্গকিলোমিটার।
১৯৬৭ সালে তা কমে হয় ১১ হাজার ৬৬৩ বর্গকিলোমিটার। বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বনের আয়তন হয়েছে ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। অর্থাৎ ১০০ বছরে সুন্দরবনের আয়তন ১ হাজার ৯০৪ বর্গকিলোমিটার কমে গেছে।
এদিকে সুন্দরবনে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের পরিমাণ নির্ণয়ে জরিপ শুরু করেছে বন বিভাগ। বনের ৪ হাজার ১৪২ দশমিক বর্গকিলোমিটারের স্থলভাগে কত প্রজাতির ও কী পরিমাণ গাছপালা রয়েছে তা জানতে এই জরিপ চালানো হচ্ছে। বন বিভাগের তথ্য মতে, ১৯০৩ সালের গবেষণায় সুন্দরবনে সুন্দরী, গেওয়া, গরান, পশুর, কাঁকড়া, কেওড়া, ধুন্দল, বাইন, খলসি, আমুর, সিংড়াসহ ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির অর্কিড ছিল। ১৯৮৫ সালের জরিপে সুন্দরবনে অরণ্য ও গুল্ম প্রজাতির সংখ্যা কমে তা দাঁড়ায় ৬৬ প্রজাতিতে। ১৯৯৭ সালের জরিপে সুন্দরবনে মাত্র ৪৮ প্রজাতির উদ্ভিদ ছিল।
এরপর ২০১৪-১৫ সালের সর্বশেষ জরিপে সুন্দরবনে গাছের প্রজাতির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৮৪টিতে। এর মধ্যে ৫৪ প্রজাতির গাছ, ২৮ প্রজাতির লতাপাতা, ১৩ প্রজাতির গাছড়া, ২২ প্রজাতির গুল্ম, ১৩ প্রজাতির ফার্ন, ১২ প্রজাতির অর্কিড, তিন প্রজাতির পরজীবী উদ্ভিদ, দুই প্রজাতির পাম, ২৮ প্রজাতির ঘাস ও ৯ প্রজাতির ছত্রাক উদ্ভিদ রয়েছে।
সিডর ও আইলায় সুন্দরবনের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা এখনো পূরণ হয়নি বলে দাবি করেছেন সুন্দরবন নিয়ে গবেষণাকারী একদল গবেষক। গবেষক দলের প্রধান ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান।
তারা জানান, প্রলয়ংকরী এ ঘূর্ণিঝড়ে সুন্দরবনের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বড় গাছ ধ্বংস হয়ে গেছে। সিডরের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের কটকা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। সেখানে এখনো রয়েছে সিডরের ক্ষত।
কটকাতে রয়েছে ভাঙ্গা গাছের শত শত গুঁড়ি। কোনো কোনো গাছকে মুচড়িয়ে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। বহু গাছ শিকড়সমেত উপড়ে পড়েছিল। পুরোনো গুঁড়িগুলো সাগরের লবণ পানিতে পচে গেছে।
তবে বনবিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বিশেষ করে সিডর-আইলার পর সরকারের পরিকল্পিত পদক্ষেপের কারণে বনের উল্লেখযোগ্য অংশে সম্পদ বেড়েছে।
সুন্দরবন বন সংরক্ষক খুলনা অঞ্চল মিহির কুমার দে জানান, দুর্যোগের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পেরেছে সুন্দরবন। সিডরের তাণ্ডবে বনের অভ্যন্তরে যে অংশ ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল সেখানে নতুন নতুন গাছ জন্মেছে। তবে নোনাপানির কারণে এখন গরান ও কাঁকড়ার মতো লবণসহিষ্ণু প্রজাতির গাছ বেশি জন্মাচ্ছে।
তিনি বলেন, বনের পশ্চিম অংশে গাছের আগামরা রোগের প্রবণতা ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে বনের নির্দিষ্ট অংশের বাইরে এই রোগ দেখা যায়নি। তবে কটকা কচিখালিতে তৃণভূমিতে গাছ কিছুটা কমেছে।
তবে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, খুলনার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা নির্মল কুমার পাল বলেন, সুন্দরবনে বন্যপ্রাণী সুরক্ষায় অভয়ারণ্য এলাকা ১ লাখ ৩৯ হাজার হেক্টর থেকে ৩ লাখ ১৭ হাজার হেক্টরে উন্নীত করা হয়েছে। বন্যপ্রাণীর প্রজননকালে বনে সব ধরনের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
বাঘ ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর সুপেয় পানির জন্য পুকুর খনন ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার জন্য উঁচু কিল্লা তৈরি করা হয়েছে। তিনি বলেন, বনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ‘সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্প’ ও ‘সুন্দরবনে বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করছে বন বিভাগ।