প্রকৃতির অভিশাপ…
এ, পি শাহেদ খাঁন
পরিবেশ কর্মী ও সমাজ সেবী
ইংরেজীতে অনেক জনপ্রিয় একটি প্রবাদ আছে যা “Revenge of Nature’’ নামে পরিচিত যেটার বাংলা আবুধানিক শব্দের অর্থ প্রকৃতির অভিশাপ। অনেকে প্রকৃতির অভিশাপ কথাটা শোনার পর ভ্রু কোঁচকাতে পারেন।
আবার অনেকে হয়তো অবাকও হবেন এটা ভেবে যে, যেখানে সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকে আজ অবধি প্রকৃতি নিঃস্বার্থভাবে দুহাত ভরে আমাদের দিয়ে গেছেন, সেখানে প্রকৃতি কিভাবে অভিশাপ দিবেন! সাদা চোখে এমনটা মনে হলেও এটাই নির্মম সত্যি।
আমাদের মনুষ্যজাতির ক্ষেত্রে আমাদের সাথে যখন বিপরীত কোনকিছু ঘটে যেয়ে আমরা ক্ষতির সম্মুখীন হই, তখন আমরা যারা প্রতিশোধ পরায়ণ তারা যতটা দ্রুত সম্ভব প্রতিশোধ নিতে উঠে-পড়ি। আর এখানেই মূলত প্রকৃতি উদার ও ব্যতিক্রম, যে দিনের পর দিন আমাদের দ্বারা অপূরণীয় ক্ষতির কবলে পড়লেও আমাদের সহজে সেটার বিনিময়ে খারাপ কোনকিছু ফেরত দেয়না।
তবে সবকিছুর তো একটা মাপকাঠি থাকে আর এক্ষেত্রেও সেটার ব্যতিক্রম নয়। তাই প্রকৃতি একটা সময় বাধ্য হয়ে আমাদের মুদ্রার ওপিঠটা দেখাতে বাধ্য হয়! আর প্রকৃতির অভিশাপ যে কতটা ভয়ংকর হতে পারে সেটা আমাদের কল্পনা শক্তিকে হার মানাবে, একবার প্রকৃতি বিরুদ্ধ আচরণ করা শুরু করলে সেটা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে আমাদের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভবপর হয়ে উঠেনা।
আমরা রোজ বায়ু দূষণ করছি, কলকারখানার বর্জ্য খালে-বিলে, নদী, সাগরে ফেলে পানি দূষণ করছি, মাটিতে প্লাস্টিক ফেলে মাটির স্বাভাবিক উর্বরতা নষ্ট করছি। মেশিনারী, গাড়ি বা যানবাহনের বিকট শব্দে শব্দদূষণ করছি।
ফলে প্রকৃতিতে পড়ছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। যার কারনে কালেকালে অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, অসময়ে বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, সুনামি, ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন দূরারোগ্য রোগের প্রাদুর্ভাব, মহামারি হয়ে দেখা দিচ্ছে।
অনিয়ন্ত্রিত ভাবে বনাঞ্চল ধ্বংস করার ফলে খরার সৃষ্টি হচ্ছে, সাথে পশু-পাখি তার আবাসস্থল হারাচ্ছে এবং ইতোমধ্যে অনেক প্রজাতির পশু-পাখি বিলুপ্তি হয়ে গেছে এবং বেশকিছু প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। ফলে পরিবেশ তার স্বীয় ভারসাম্য হারাচ্ছে। বর্জ্যসহ নানা উপায়ে পানি দূষণের ফলে জলাশয়ে আজ আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায়না এবং অনেক জলজ প্রাণীরা অস্তিত্ব হুমকির মুখে।
প্রায় সবধরনের যানবাহনের রাস্তায় উচ্চ শব্দে অগণিত মানুষের কানের সমস্যাসহ উচ্চ রক্তচাপ, মাইগ্রেন, হৃদপৃন্ডের নানান সমস্যা দিনদিন পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলছে। শুধু যে মনুষ্যজাতির সমস্যা হচ্ছে সেটা না, এমন বিকট শব্দে বিভিন্ন পশু-পাখি ভীতগ্রস্থ হয়ে আমাদের চারপাশ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
আমরা প্রতিনিয়ত নিজেদের স্বার্থে কোন নিয়ম না মেনেই বালি, পাথর, কয়লা উত্তোলন ও পাহাড় কেটে নতুন নতুন ভূমি বের করে উল্টো নিজেদের অপূরণীয় ক্ষতি করেই চলছি। যার ফলে প্রকৃতির অভিশাপ হয়ে ভূমিকম্প, সুনামি প্রভৃতির মাত্রা তুলনামূলক বেড়ে গেছে।
আমরাই মানুষরা আমাদের সুখের জন্য, বেশি আয়েশি জীবন-যাপনের জন্য, বেশিবেশি লাভ ও লোভের জন্য প্রকৃতির প্রতিনিয়ত ক্ষতি করে চলছি। যার ফলে প্রকৃতি আজ আমাদের অনুকূলে নেই।
এখন সময় আমাদের ভূল সুধরানোর, এখন হতে যাতে আমরা প্রকৃতির আর কোন ক্ষতি না করি – তার সপথ নেওয়ার সময় এখনই। এবিষযে আমাদেরকে দ্রুত সতর্ক হতে হবে।
আমাদেরকে বায়ু দূষণ বন্ধ করতে হবে, কলকারখানাসহ মিউনিসিপ্যাল বর্জ্য খালে-বিলে, নদী, সাগরে ফেলে না ফেলে সঠিক কর্জ্য ব্যবস্থাপনা করতে হবে, প্লাস্টিকসহ অপচনশীল দ্রব্যের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে, গাছ কাটা, বন উজাড় বন্ধ করে বেশী বেশী গাছ লাগাতে হবে। মাটি দূষণ, পানি দূষণ বন্ধ করতেদ হবে, যত্রতত্র ময়লা-আবজনা পেলে পরিবেশ দূষণ বন্ধ করতে হবে।
পরিশেষে এটাই সর্বপরি সবার মনে রাখতে হবে প্রকৃতির উপর যতই আমরা প্রকৃতিপ্রেমী হবো ততই বিশ্বের জন্য কল্যাণকর হবে। স্ব স্ব দেশের পকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখতে পারলেই প্রাকৃতিকভাবে অক্সিজেন নির্মল হবে এবং বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কমে যাবে।
মনে রাখতে হবে প্রকৃতি দূষণমুক্ত থাকলে আমরা যেমন থাকব নিরাপদ থাকব, তেমনি ভবিষ্যত প্রজন্ম পাবে একটি নিশ্চিত চিন্তামুক্ত স্বাভাবিক জীবন। তাই প্রকৃতির মত নিঃস্বার্থভাবে প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শিখুন প্রকৃতি কখনোই আপনাকে নিরাশ করবে না।
আসুন মানব জাতির বৃহৎ স্বার্থে পরিবেশ বাঁচাই, বিশ্ব বাঁচাই। নির্মল অক্সিজেনে ভরে উঠুক আবারও পৃথিবী এবং সেই সাথে প্রিয় বসুধায় নেমে আসুক অনন্তকালের জন্য প্রশান্তির বসন্ত।