পোশাক কারখানার পানিতে বিপজ্জনক রাসায়নিক
বাংলাদেশের যেসব এলাকায় গার্মেন্টস কারখানা আছে সেসব এলাকা, বিশেষ করে ঢাকার নদী, খাল ও কলের পানিতে বিপজ্জনক মাত্রায় পার এবং পলিফ্লুরোঅ্যালকাইল সাবস্ট্যান্সেস (পিএফএএস) বা ‘ফরেভার কেমিক্যালস’ বা চিরস্থায়ী রাসায়নিকের উপস্থিতি আছে। সম্প্রতি এক গবেষণা থেকে এ তথ্য উঠে এসেছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
পরিবেশ নিয়ে কাজ করা ঢাকা ভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো) এবং পরিবেশবাদী এনজিওগুলোর জোট আইপেনের যৌথ গবেষণা থেকে এ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এসব রাসায়নিকের অনেকগুলোই মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় পোশাক সরবরাহকারী দেশ বাংলাদেশ। তবে গার্মেন্টসে ব্যবহৃত রাসায়নিক পানিতে কী ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে তা জানতে এই প্রথম কোনো গবেষণা পরিচালিত হলো। গবেষণায় রাজধানী ঢাকায় গার্মেন্টস কারখানা আছে এমন ২৭টি স্থান থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা করা হয়েছে।
পারফ্লুরোঅ্যালকাইল সাবস্ট্যান্সেসে ও পলিফ্লুরোঅ্যালকাইল সাবস্ট্যান্সেসে প্রায় ১০ হাজার রকমের রাসায়নিকের উপস্থিতি আছে, যার কারণে ক্যানসারসহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক জটিলতা তৈরি হতে পারে।
১৯৫০—এর দশক থেকে এ ধরনের রাসায়নিক বিভিন্ন ভোক্তা পণ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা পিএফএএসকে চিরস্থায়ী রাসায়নিক বলেন। কারণ, এগুলো একবার তৈরি হওয়ার পর যেখানে ফেলা হয় সেখানে কয়েক শ থেকে কয়েক হাজার বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। এমনকি পানিতেও যদি পিএফএএস ফেলা হয়, সেগুলোও টিকে থাকে কয়েক শ বছর। বিশ্বে যে পরিমাণ পিএফএএস ব্যবহৃত হয়, তার ৫০ শতাংশই হয় পোশাকশিল্পে।
বাংলাদেশে এসডোর নির্বাহী পরিচালক সিদ্দিকা সুলতানা বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি আন্তর্জাতিক টেক্সটাইল উৎপাদনকেন্দ্র এবং এই সেক্টর থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক নির্গমনের প্রসার আমাদের দেশের বাসিন্দাদের উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। পোশাক রপ্তানি শিল্প পিএফএএস দিয়ে আমাদের নদী, হ্রদ ও কলগুলো দূষিত করছে—বিষয়টি বিনা ক্ষতিপূরণে পার পাওয়া উচিত নয়।’
স্টকহোম কনভেনশনের অধীনে বিশ্বব্যাপী বেশ কিছু পিএফএএস নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশও এই কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। এই কনভেনশন মূলত ক্রমাগত জৈব দূষকগুলোর প্রভাব থেকে মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশকে রক্ষা করার চুক্তি।
গবেষকেরা দেখতে পেয়েছেন, ২৭টি নমুনা থেকে পাওয়া ৬৭ শতাংশ রাসায়নিক আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ। যেসব এলাকায় পোশাক কারখানা আছে, সেসব এলাকায় এসব দূষকের উপস্থিতির হার উচ্চ। এই বিষয়টি নির্দেশ করে যে, এসব পিএফএএস পানি দূষণের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ।
রাজধানীর অদূরে সাভারের কর্ণতলী নদী থেকে নেওয়া নমুনায় সবচেয়ে বেশি পরিমাণ পিএফএএস পাওয়া গেছে, যা ইউরোপীয় ইউনিয়ন নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে ৩০০ গুণ বেশি।
এই নদীতে পাওয়া দূষক পিএফএএসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আছে নির্দিষ্ট দুই ধরনের পিএফএ। কর্ণতলী নদীতে নেদারল্যান্ডস সরকারের বেঁধে দেওয়া সীমার চেয়ে পারফ্লুরোওকটানোয়িক অ্যাসিড ১ হাজার ৭০০ গুণ বেশি পাওয়া গেছে এবং পারফ্লুরোওকটেন সালফোনেট সীমার চেয়ে ৫৪ হাজার গুণ বেশি পাওয়া গেছে।
পিএফএএসের জন্য বাংলাদেশের কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই, তাই গবেষণায় ফলাফলের তুলনা করা হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, নেদারল্যান্ডস এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানদণ্ডের সঙ্গে।
গবেষণার প্রধান লেখক শাহরিয়ার হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ, যেখানে বিশাল জনসংখ্যা আছে। জলাশয়গুলো সেচ, কৃষি, শিল্প উন্নয়ন ও পানীয় জলের প্রধান উৎস।
আমরা দেখেছি যে, পানি অত্যন্ত বিষাক্ত রাসায়নিক দ্বারা দূষিত এবং এটিকে একটি বড় সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করে এর সমাধান করা দরকার।’
শাহরিয়ার হোসেন আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ স্টকহোম কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী হয়ে থাকলে পিএফএএস নিয়ন্ত্রণ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।’