পরিবেশ রক্ষায় জনগনকে সচেতন হতে হবে
দেশে পরিবেশ দূষণ উদ্বেগজনক মাত্রায় বেড়েছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক এলাকার অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। শিল্প-কারখানাসৃষ্ট দূষণে এরই মধ্যে এখানকার বায়ু, পানি, নদ-নদী জর্জরিত।
যাচাই-বাছাই করে শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে ছাড়পত্র দেয়া এবং দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া পরিবেশ অধিদপ্তরের অন্যতম কাজ। একইভাবে দূষণের সঙ্গে কারা জড়িত এবং তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তার তথ্য বিস্তারিতভাবে জনসম্মুখে প্রকাশ করাও সংস্থাটির দায়িত্ব।
আগে নিয়মিত করলেও সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তর দূষণকারী বড় প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করছে না। বড় শিল্প মালিকদের মান বাঁচাতেই নাকি এ পদক্ষেপ।
দীর্ঘদিন ধরে চর্চিত দূষণকারীর নাম প্রকাশের বিষয়টি এক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক রীতিতে পরিণত হয়েছে। হঠাৎ করে এটা বন্ধ করা দুর্ভাগ্যজনক। একটি রাষ্ট্রীয় সংস্থা হিসেবে পরিবেশ অধিদপ্তরের এ প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মের ব্যত্যয় কাম্য নয়।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে পরিবেশ অধিদপ্তর পরিবেশ সুরক্ষা ও দূষণ রোধে কাজ করছে। কিন্তু সময়ান্তরে প্রতিষ্ঠানটিতে সুশাসন সংকট তীব্রতর হয়েছে। টিআইবির গবেষণায় দেখা গেছে, আমলানির্ভরতা, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার ও নিরীক্ষায় ঘাটতি, পেশাগত দক্ষতার অভাবসহ বিভিন্ন কারণে অনেকটা অকেজো হয়ে পড়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
কর্মীদের একাংশের অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বড় অংকের নিয়মবহির্ভূত আর্থিক লেনদেন এবং তা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ঘাটতির ফলে সংস্থাটিতে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে।
অধিদপ্তরের কর্মীদের একাংশের সঙ্গে পরিবেশ দূষণকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের একাংশের যোগসাজশ এবং তাদের প্রভাবের কাছে আত্মসমর্পণ করার কারণে প্রতিষ্ঠানটির কার্যকারিতা ব্যাহত হচ্ছে।
পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের ওপর থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি এক ধরনের বিপরীতমুখী ভূমিকা পালন করছে। দূষণকারীর নাম প্রকাশ না করার সাম্প্রতিক মৌখিক সিদ্ধান্ত তারই প্রতিফলন।
এর মধ্য দিয়ে পরিবেশ সুরক্ষার পরিবর্তে গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষার বিষয়টি আবারো প্রমাণ হয়েছে। এটা হতাশাজনক। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে পরিবেশ অধিদপ্তরকে সার্বিকভাবে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন।
পরিবেশ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে দেশে অন্তত দুই যুগ আগে প্রণয়ন করা হয়েছে আইন। ১৯৯৫ সালে গৃহীত সেই ‘পরিবেশ সংরক্ষণ আইন’ যথেষ্ট ভালো একটি আইন। পরিবেশ দূষণসংক্রান্ত অপরাধের বিচার করার জন্য দেশে তিনটি পৃথক আদালতও রয়েছে।
কিন্তু এ আইনের পর্যাপ্ত প্রয়োগ হচ্ছে না বলে পরিবেশ দূষণসংক্রান্ত অপরাধগুলো যথাযথ গুরুত্ব পাচ্ছে না। যাদের কর্মকাণ্ডের ফলে পরিবেশের দূষণ ঘটছে, তাদের মধ্যে এটা অনুধাবনে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে যে তাদের ওইসব কর্মকাণ্ড পরিবেশ সুরক্ষা আইন অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ কিংবা তারা সেগুলোকে অপরাধ বলে গণ্য করলেও এ রকম ভেবে নিশ্চিন্ত থাকেন যে কিছু জরিমানা পরিশোধের মাধ্যমেই ওইসব অপরাধের শাস্তি এড়ানো সম্ভব।
রুটিন কাজ হিসেবে পরিবেশ অধিদপ্তর বিভিন্ন কারখানা বা স্পট পরিদর্শন করে আসছে। দূষণের কারণ শনাক্ত করে দায়ীদের অনেক ক্ষেত্রে আর্থিক জরিমানা করছে। কিন্তু কঠোর শাস্তি দেয়া হচ্ছে না।
ফলে পরিবেশ দূষণ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। কাজেই ভালো আইন থাকা সত্ত্বেও কার্যকর প্রয়োগের অভাবে এর প্রত্যাশিত সুফল মিলছে না। সুতরাং অবস্থা পরিবর্তনে চাই পরিবেশ অধিদপ্তরের বিশেষ সক্রিয়তা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিষ্ঠানটি এখনো কিছু প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতায় ভুগছে। পরিবেশ একটি সর্বব্যাপ্ত বিষয় হলেও মাত্র ২১টি জেলায় পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যালয় আছে। ফলে কোনো কোনো কার্যালয়কে একই সঙ্গে তিন-চারটি জেলায় কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। তদুপরি পরিবেশ অধিদপ্তরের অবকাঠামোগত ও লজিস্টিকসের ঘাটতি রয়েছে।
পরিবেশগত ছাড়পত্র আবেদন পদ্ধতি অনলাইনভিত্তিক করা হলেও প্রদান ও নবায়ন সম্পূর্ণভাবে ডিজিটালাইজড করা হয়নি। পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ কর্মকাণ্ড পরিচালনাসহ তদারকি ও পরিবীক্ষণে আধুনিক প্রযুক্তির ঘাটতি রয়েছে।
এছাড়া সংস্থাটি কার্যক্রমে জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেম (জিআইএস) ও রিমোট সেনসিং প্রযুক্তির সম্প্রসারণ করা হয়নি। ম্যানুয়ালি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করায় পরিবেশ অধিদপ্তর সঠিকভাবে দূষণের মাত্রা শনাক্ত করতে পারে না। প্রতিষ্ঠানটির কার্যকারিতা বাড়াতে এসব ঘাটতি দূর করা সময়ের দাবি।