পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে প্রতিবছর ২ বর্গকিলোমিটার এলাকায় মরুকরণ হচ্ছে
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্ব আজ নানা ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং খরার মতো সমস্যাগুলো আমাদের জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে আমাদের এই সবুজ পৃথিবী ক্রমে মরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
মরুকরণের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ভৌগোলিক এলাকাগুলো হলো, আফ্রিকা (সাহেল অঞ্চল), এশিয়া (গোবি মরুভূমি এবং মঙ্গোলিয়া) এবং দক্ষিণ আমেরিকার কিছু অংশ।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার এলাকায় মরুকরণ হচ্ছে। বাংলাদেশেও এ সমস্যাগুলো প্রকট আকার ধারণ করছে। আমাদের দেশের অর্থনীতি, কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তা, জ্বালানি, জীববৈচিত্র্য, স্বাস্থ্য, সুপেয় পানি ও উপকূলবর্তী এলাকার ওপর এই প্রভাব গুরুতরভাবে পড়ছে।
আবার গ্রীষ্মকালে তাপপ্রবাহ আমাদের জীবনে দুর্বিষহ অবস্থা সৃষ্টি করছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও মরুকরণের কারণে পানির প্রাপ্যতা কমে যাচ্ছে, যা কৃষির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে, ফসলের উৎপাদন কমে যাচ্ছে, যা খাদ্যসংকটের অনেক বড় কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
দীর্ঘ সময় বৃষ্টিহীন অবস্থা থাকলে অথবা অপর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হলে মাটির আর্দ্রতা কমে যায়। সেই সঙ্গে মাটি তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য বা কোমলতা হারিয়ে রুক্ষ রূপ গ্রহণ করে খরায় পরিণত হয়। আবার জলবায়ু পরিবর্তন, খরা ও মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফলে উর্বর ভূমির ধীরে ধীরে মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়াই হচ্ছে মরুকরণ।
শুষ্কভূমি সাধারণত পরিবেশগত দিক থেকে খুবই নাজুক এবং এমন ভূমিই মরুকরণের শিকার হয়। মরুকরণের ফলে ভূমি হারিয়ে ফেলে উৎপাদন ক্ষমতা, হয়ে যায় অনুর্বর।
আর এই মরুকরণ প্রক্রিয়ার ফলে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি বৃদ্ধি পায় এবং তাপপ্রবাহ সৃষ্টি করে যার পরিণাম আমরা প্রতিনিয়ত ভোগ করে চলেছি।
জাতিসংঘের আইপিসিসির রিপোর্ট অনুযায়ী, গত এক দশকে ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা প্রায় ১ দশমিক ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা আরও ০.৫০ থেকে ১ দশমিক ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা।
বাংলাদেশ মেটেরিওলজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট (বিএমডি) এর রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশের গড় তাপমাত্রা গত ৫০ বছরে প্রায় ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। গড় তাপমাত্রা পরিবর্তন হওয়ায় বৃষ্টিপাতের ধরন ও সময় বদলে গেছে।
এখন আর প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে যথা সময়ে ঋতুর আবির্ভাব ঘটছে না এবং ঋতুর সংখ্যাও হ্রাস পেয়েছে। এ ছাড়া বিলম্বিত হচ্ছে শীত ও বর্ষার আগমন অথবা অসময়ে ভারী বর্ষণ কিংবা ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে বরফ গলে গিয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ১৭ শতাংশ এলাকা সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রধান কারণগুলো হলো অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নগরে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, পরিবেশ ব্যবস্থাপনা এবং নির্বিচারে বৃক্ষনিধন। বনভূমি কেটে ফেলার কারণে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই–অক্সাইড ও গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, যা তাপমাত্রা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। এই গ্যাসগুলো সৌর বিকিরণ শোষণ করে এবং তা পুনরায় বায়ুমণ্ডলে ছেড়ে দেয়, ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়।
বিশ্বজুড়ে খরার প্রভাবে প্রতিনিয়ত ফসলের উৎপাদন কমে যাচ্ছে এবং খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। আফ্রিকার সাহেল অঞ্চল, অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া খরার কারণে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১৩ থেকে ১৪টি জেলায় খরা দেখা যায়।
বৃষ্টিপাত না হওয়া, পর্যাপ্ত বনায়ন না থাকা, কৃষিজমি ও জলাধার দখল হয়ে যাওয়ার কারণে খরার ঝুঁকি আরও বাড়ছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের রিপোর্ট অনুযায়ী, খরার কারণে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল অঞ্চলে ফসলের উৎপাদন প্রায় ২০-৩০ শতাংশ কমে গেছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তরের রিপোর্ট অনুযায়ী, এই এলাকাগুলোতে মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা কৃষি উৎপাদনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। যথেচ্ছভাবে বৃক্ষনিধনের ফলে স্থানীয় আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটছে এবং মাটির উপরিভাগ আলগা হয়ে বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যাচ্ছে।
খরার ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হ্রাস পায়, আবহাওয়ার তাপমাত্রা ও বায়ুর গতি পরিবর্তিত হয় এবং এতে মরুকরণ ত্বরান্বিত হয়। খরার কারণে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, ফলে সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য হুমকি তৈরি হচ্ছে।
জাতিসংঘের ডেজার্টিফিকেশন রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রায় দুই বিলিয়ন মানুষ মরুকরণের ঝুঁকিতে রয়েছে। মরুকরণের প্রভাবে উত্তর আমেরিকার ৪০ শতাংশ আবাদি ভূমি মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে।
অন্যদিকে সাহারার দক্ষিণ অংশে গত ৫০ বছরে ৬ লাখ ৫০ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূমি গ্রাস করে নিয়েছে মরুভূমি। বিশ্বের প্রায় ৭০ শতাংশ জলভূমি ইতিমধ্যেই মরুকবলিত হয়ে পড়েছে এবং প্রতি মিনিটে ৪৪ হেক্টর আবাদি ভূমি এবং ২০ হেক্টর বনভূমি মরুকরণ হচ্ছে অর্থাৎ বছরে ৭০ লাখ হেক্টর জমি মরুকরণের শিকার হচ্ছে।
বাংলাদেশে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকা এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বরেন্দ্র অঞ্চল নামে খ্যাত নওগাঁ, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের আবহাওয়ায় মরুময়তার লক্ষণ স্পষ্ট পরিলক্ষিত হচ্ছে। আবার পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় পরিচালিত ২০২০ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশে মোট নদীর মধ্যে মৃত ও মৃতপ্রায় নদীর সংখ্যা প্রায় ১৪০টি।
ভূমির মরুতে রূপান্তরের প্রধান কারণ হলো বনভূমির নিধন। খরা ও মরুকরণের কারণে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, যা খাদ্যনিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পানির স্তর বছরে গড়ে স্থানভেদে দুই থেকে তিন ফুট করে নিচে নেমে যাচ্ছে এবং এই হার অব্যাহত থাকলে আগামী ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে এ দেশের উত্তরাঞ্চল সম্পূর্ণ মরুভূমিতে পরিণত হতে পারে।