পরিবেশ দূষণে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে শিশুরা
একটি শিশুর মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ট হওয়া, বেড়া ওঠা প্রতিটি পর্যায়ে বাংলাদেশের শিশুদের পরিবেশগত স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবেলা করতে হয়।
পরিবেশ দূষণ, বিশেষ করে- বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ, তীব্র তাপদাহের প্রভাব এবং রাসয়নিক ধাতুর বিষক্রিয়া (সীসা, আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম এবং পারদ) এর কারণে শিশুদের স্বাস্থ্যে মারাত্মক নেতিবচক প্রভাব সৃষ্টি করে। দূষণজনিত কারণে ত্রুটি নিয়ে শিশু জন্মাতে পারে, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।
জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফ’র তথ্য মতে, বাংলাদেশের শিশুদের জলবায়ু ঝুঁকি সূচকে ১৬৩ টি দেশের মধ্যে ১৫৭তম স্থানে রয়েছে, যা শিশুদের জন্য অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকি নির্দেশ করে। বায়ু দূষণ বার্ষিক জিডিপির ৩ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ হ্রাস করে।
এমনকি দেশে সম্প্রতি বয়ে যাওয়া তাপপ্রবাহ, বন্যা, নদী ভাঙন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিবেশগত অভিঘাতে পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে শিশুরা। আর তাই শিশুদের স্বাস্থ্যের মাারাত্মক এই নেতিবচক প্রভাব বিষয়ে সঠিক তথ্য নিরুপনে গবেষণা শুরু করেছে জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসক প্রতিষ্ঠান (নিপসম)।
গবেষণায় দেশের শিশুদের মধ্যে বায়ু ও শব্দ দূষণ, রাসয়নিক ধাতুর বিষক্রিয়া এবং তীব্র তাপদাহ সম্পর্কিত স্বাস্থ্যের প্রভাব, এই প্রক্রিয়ায় মধ্যে এক্সডোজার সূচক এবং স্বাস্থ্য সমস্যার পরিমান নির্ণয়, এ সম্পৃক্ত অসুস্থততা এবং মৃত্যু ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
এ প্রসঙ্গে গবেষণায় ফোকাল পার্সন নিপসমের পেশা ও পরিবেশ স্বাস্থ্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আইরিন হোসেন বলেন, ইউনিসেফ’র সহযোগীতায় গবেষণা কার্যক্রম পরিচালতি হবে বছর জুড়ে গোটা দেশব্যাপী। সার্বিক তত্ত্ববধানে থাকবেন প্রতিষ্ঠাটির পরিচালক প্রফেসর ডা. শামিউল ইসলাম।
এই গবেষণা সফলভাবে সম্পন্ন হলে, দেশের শিশুদের ওপর শব্দ ও বায়ু দূষণ এবং তীব্র তাপপ্রবাহের ক্ষতিকর প্রভাব এর প্রতিকার সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করা সম্ভব হবে। এতে অনেক শিশুকে জটিল অসুস্থতা ও অপ্রতাশিত মৃত্যু থেকে বাচাঁনো সম্ভব হবে।
তরুণ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মালিহা খান মজলিশ বলেন, শিশুদের পরিবেশগত স্বাস্থ্য ঝুঁকি একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক উদ্বেগ। যা শিশুদের সামগ্রীক সুস্থতা ও বিকাশে উল্লেখযোগ্যা প্রভাব বিস্তার করে। তাই এই বিষয়ে নিপসম’র গবেষণা একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত।
এর মাধ্যমে শিশুরা পরিবেশের কারনে যে নানাবিধ মাারাত্মক সমস্যা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে তা উঠে আসবে। একই সঙ্গে পরিবেশ ও শিশু স্বাস্থ্যের উন্নয়নে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য এই গবেষণা বিভিন্ন নীতি বাস্তবায়নে সহায়ক হবে এবং অরক্ষিত জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেবে।
২০১৮ সালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে দেখা গেছে, পরিবেশগত ঝুঁকি মোকাবেলার মাধ্যমে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব।
তীব্র গরম শিশু এবং গর্ভবতী মায়ের ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে। ফলে শিশু জন্মের ক্ষেত্রে জন্মগত ত্রুটির মতো নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়। এছাড়া বাংলাদেশে চরম আবহাওয়া এবং তীব্র বায়ু দূষণসহ বিভিন্ন পরিবেশগত বিপর্যয় এর মুখোমুখি হতে হয়।
বাংলাদেশ ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী সপ্তাম স্থানে রয়েছে, যা শিশুদের স্বাস্থ্য ও সুস্থতার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ইউনিসেফ এবং বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার একাধিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপি প্রায় ৮০ কোটি শিশুর রক্তে বিপজ্জনকভাবে সীসার মাত্রা বেশি। যা বিশ্বের মোট শিশুর এক-তৃতীয়াংশ।
এছাড়া বায়ু দূষণে ১৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের ৯৩ শতাংশকে প্রভাবিত করে। যার ফলে এসব শিশুদের শ্বাসকষ্টজনিত জটিলতা দেখা দেয় এবং বছরে লক্ষাধিক শিশুর মৃত্যু ঘটে।
ইউনিসেফ’র তথ্য মতে, বাংলাদেশের শিশুদের জলবায়ু ঝুঁকিসূচকে ১৬৩ টি দেশের মধ্যে ১৫৭তম স্থানে রয়েছে, যা শিশুদের জন্য অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকি নির্দেশ করে। বায়ু দূষণ বার্ষিক জিডিপির ৩ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ হ্রাস করে।
ইউনিসেফের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে প্রতি তিন শিশুর একজন বা প্রায় ২ কোটি শিশু প্রতিদিন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির শিকার হচ্ছে। ২০৫০ সাল নাগাদ দেশের মোট ৯৯ শতাংশ বা ৩ কোটি ৫৫ লাখ শিশু প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের সম্মুখীন হবে।
এ সংখ্যা ২০২০ সালের তুলনায় উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেশি। ২০২০ সালে মাত্র ২৬ লাখ শিশু, যা দেশের মোট শিশুর ৫ শতাংশ, এই ধরনের ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছিল।
প্রতিবেদনের তথ্য মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। এর প্রভাবে হঠাৎ গরম অনুভূত আবার হঠাৎ ঠান্ডা অনুভূত। আবার অনেক সময় পরিবেশের কারণে নানাবিধ রোগ-ব্যাধি দেখা দেয়। সম্প্রতি দেশের উপর দিয়ে বয়ে গেছে, তীব্র তাপদাহ। এটিও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব।
তাপমাত্রা প্রতি ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধিতে অপরিণত শিশু জন্মের ঝুঁকি ৫ শতাংশ বাড়ে। তাপপ্রবাহ না থাকা সময়ের তুলনায় তাপপ্রবাহের সময়ে এ হার ১৬ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। এর অর্থ, তাপপ্রবাহের সময়ে অপরিণত শিশু জন্মের ঝুঁকি অনেক বেশি।
অর্থাৎ তাপপ্রবাহ যত বেশি এবং যত তীব্র হবে ঝুঁকি তত বাড়বে। বাংলাদেশে অপরিণত শিশুজন্মের হার বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি (১৬ দশমিক ২ শতাংশ) এবং তাপপ্রবাহে এটি আরও বাড়ে। আর তাই স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় ইউনিসেফের সহযোগীতায় স্বাস্থ্য অধিদফতর জাতীয় নীতিমালা বা গাইডলাইন প্রকাশ করেছে। এটিও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত বলছেন সংশ্লিষ্টরা।