গত কয়েক বছর ধরে পরিবেশ দূষণের কারণে শহরাঞ্চলের মানুষের মৃত্যুর হার এমনভাবে বাড়ছে যেন তা মৃত্যুকুপের রূপ পরিগ্রহণ করছে। পরিবেশ দূষণের কারণে প্রতিনিয়ত অসুস্থ হয়ে মারা যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষে।মূলত, বাংলাদেশে বায়ুদূষণ, খাদ্যদূষণ এবং পানিদূষণ, প্রধানত এই তিনটি কারণে মানুষের মৃত্যুহার বেশি।
মৃত্যুহার কমাতে পরিবেশ দূষণ রোধে সরকারি আইন পাস হলেও এক্ষেত্রে সরকারের তেমন কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা। তাদের অভিযোগ, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ তৎপর নয়। দূষণ পরিমাপে যেসব যন্ত্র বব্যহার করা হয় তাও আধুনিক নয়। সচেতনতামূলক কর্মসূচি নেই বললেই চলে।
সম্প্রতি এক জরিপ প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলছে, শুধু ঢাকাতেই গত এক বছরে ১৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং সারাদেশের শহরাঞ্চলে মারা গেছে ৮০ হাজার। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের একটি জরিপের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, পরিবেশ দূষণের কারণে দেশের মানুষ যে ক্ষতির মুখে আছে তার সামান্য অংশই বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। বাস্তবে ক্ষতির পরিমাণ এর চেয়ে অনেক অনেক বেশি।
ঢাকা, পাবনা ও কক্সবাজার শহরে ওপর জরিপ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালে সারাবিশ্বে পরিবেশ দূষণগত কারণে মারা গেছে গড়ে ১৬ শতাংশ মানুষ। আর বাংলাদেশে ২৮ শতাংশ। এই সময় দেশের শহরাঞ্চলে পঙ্গুত্ব বরণসহ নানা ক্ষতির শিকার হয়েছেন ২৬ লাখ ২৭ হাজার ৯২৬ জন। শুধু ঢাকা-শহরে ক্ষতির শিকার হয়েছেন ৫ লাখ ৭৮ হাজার ৭৮১ জন।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘পরিবেশ দূষণের কারণে ২০১৮ সালে শুধু শহরাঞ্চলেই মারা গেছেন ৮০ হাজার ২৯৪ জন মানুষ। এর মধ্যে বায়ু দূষণজনিত কারণে মারা যান প্রায় ৪৬ হাজার এবং পানি, অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্য বিধিসংক্রান্ত কারণে মারা গেছে প্রায় ৩৪ হাজার মানুষ। পানি, স্যানিটেশন এবং অস্বাস্থ্যগত প্রত্যক্ষ প্রভাবে মারা গেছেন ৪ হাজার ৮০০ জন, পরোক্ষ প্রভাবে ৯৬৬ জন, পানিতে আর্সেনিকের কারণে প্রায় ১০ হাজার এবং পেশাগত পরিবেশ দূষণে মারা গেছেন প্রায় ১৯ হাজার মানুষ।
প্রিভেনটিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী এ সম্পর্কে বলেন, ‘বাংলাদেশে বায়ুদূষণ, খাদ্যদূষণ এবং পানিদূষণ, প্রধানত এই তিনটি কারণে মানুষের মৃত্যুহার বেশি। অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার, অতিরিক্ত সার ব্যবহার, খাদ্যকে সংরক্ষণের জন্য ফরমালিন ও কারবাইড্রেড ব্যবহারের কারণে খাদ্য-দূষণ হচ্ছে। এই খাবার খেয়ে মানুষ বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। আবার এই খাবারগুলো খাওয়ার কারণে কিডনি, লিভার, পাকস্থলি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে কিডনি ফেইলিওর, গ্যাস্ট্রিক, আলসার আক্রান্ত হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে।
পরিবেশ দূষণের কারণে এত মৃত্যুকে এক ধরনের পরিবেশ দূষণের ফল বলে মনে করেন না পরিবেশ, পানি ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপন ড. আইনুন নিশাত। তিনি বলেন, ‘এটা সার্বিকভাবে পরিবেশ দূষণ সমন্বিত নেতিবাচক ফল। বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, খাদ্যদূষণ, শব্দদূষণের সমন্বিত প্রভাব পড়ছে জনস্বাস্থ্যের ওপর।জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়ছে। ফলে খাবার পানির সঙ্কট তৈরি হয়েছে। তারা রেশনিং করে পানি খায়। এর কারণে তাদের কিডনির ওপর প্রভাব পড়বে, রক্তচাপ বাড়বে।
ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার বলেন,বায়ুদূষণের জন্য অ্যাজমা, শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা, অ্যালার্জিসহ নানা রোগে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে । পানিদূষণের কারণে টাইফয়েড, আমাশয়, কলেরা প্রভৃতি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। শব্দদূষণের কারণে মানসিক চাপ বেড়ে যাচ্ছে।হৃদরোগের আক্রান্তর ঝুঁকিও বেড়ে গেছে। শব্দদূষণের কারণে উদ্বেগ বেড়ে যায়, যা হার্টের রোগ বাড়ায়, রক্ত চাপ বাড়ায়, অনিদ্রা রোগও বাড়ে। এসবই মৃত্যুর কারণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শহীদ আখতার হোসেন বলেন, পরিবেশ দূষণের একটি বড় কারণ হচ্ছে বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণের ঘটনা দুভাবে ঘটে একটি হলো ক্ষুদ্র কণিকার কারণে। আরেকটি হলো নানা কেমিক্যাল ও দূষিত পদার্থের কারণে। আমরা এসব বিষয় নিয়ে গবেষণা করছি। আর নানা রোগের সঙ্গে এর কী কার্যকারণ সম্পর্ক আছে তাও আমরা দেখার চেষ্টা করছি।’
তিনি আরো বলেন, দূষণরোধে সরকারের কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ তেমন দক্ষ ও তৎপর নয়। দূষণ পরিমাপে যেসব যন্ত্র বব্যহার করা হয় তাও আধুনিক নয়। সচেতনতামূলক কর্মসূচি নেই বললেই চলে।