পরিবেশবান্ধব সবুজ বাহন বাইসাইকেল
সবসময় সুস্থ থাকা ও স্বুস্বাস্থ্য ধরে রাখার জন্য আমরা বিভিন্ন ধরনের ব্যায়াম করে থাকি। তবে ব্যায়ামের মধ্যে সবচেয়ে ভালো হচ্ছে সাইক্লিং ও সাঁতার কাটা। সাইক্লিং বা সাইকেল চালনায় অনেক শারীরিক পরিশ্রম হয় এবং ওজন কমাতে ব্যাপক সহায়তা করে। এ ছাড়া ক্যানসার, ডায়াবেটিস, প্রেশারসহ নানা ধরনের রোগের ঝুঁকিও বহুলাংশে কমিয়ে দেয় এবং ফিটনেস ধরে রাখে।
পেশাদার সাইকেল আরোহীদের দেখে থাকলে অনেকেই হয়তো লক্ষ করেছেন যে, তাদের অধিকাংশেরই স্বাস্থ্য অত্যন্ত ভালো থাকে। সাইকেল চালানো শুধু বাহ্যিকভাবেই ফিট রাখে না, অভ্যন্তরীণভাবেও সুস্থ রাখে।
সাইকেল যেমন স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী; তেমনি পরিবেশের জন্যও উপকারী। সাইকেলকে পরিবেশবান্ধব সবুজ বাহন বলা হয়ে থাকে। অনেকেই শুধু আনন্দের জন্য সাইকেল চালান। তবে এর উপকারিতাগুলো জানলে অনেকেই উৎসাহ নিয়ে সাইকেল চালাবেন। স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাইক্লিং এর বিকল্প নেই।
সংক্ষিপ্ত থেকে মাঝারি দূরত্বের ক্ষেত্রে সাইক্লিং খুবই ফলপ্রসূ এবং পরিবহনের কার্যকরী একটি উপায় হিসেবে ধরা হয়। মোটরগাড়ির তুলনায় বাইসাইকেল অনেক বেশি সুবিধা দিয়ে থাকে। যেমন সাইক্লিং, সহজ পার্কিং, সহজেই নড়াচড়া করা ক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদির কারণে স্থায়ী শারীরিক ব্যায়াম করা যায় এবং এর দ্বারা রাস্তা, সাইকেলের পথ ও গ্রামীণ সড়কে সহজে প্রবেশ করা যায়।
সীমিত জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার, স্বল্প বাতাস ও শব্দদূষণ এবং খুবই অল্প পরিমাণে যানজট সৃষ্টির মতো সুবিধাও সাইক্লিং দিয়ে থাকে। এটি ব্যবহারকারী তথা সমাজের আর্থিক খরচ বিশালভাবে কমিয়ে আনে।
এটি রাস্তার খুবই সামান্য ক্ষতি করে, অল্প পরিমাণ রাস্তার ব্যবহার করা হয়। সম্প্রতি রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে সাইকেল লেন সচল রাখতে ভাঙা হলো লেনের মধ্যে থাকা পুলিশ বক্স।
এ ছাড়া দ্বিতীয় দিনের অভিযানে প্রথম দিনের অভিযানের পর ফের দখল হওয়া ভ্রাম্যমাণ দোকানও পুনরায় উচ্ছেদ করা হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আগারগাঁওয়ের সাইকেল লেনও দখলমুক্ত করা হবে বলে জানিয়েছে এবং ধীরে ধীরে পুরো শহরের যেখানেই রাস্তা আছে সেখানেই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন রাস্তার দুই পাশে সাইকেল লেন রাখার পরিকল্পনা করছে। এটা সাইকেল চালকদের জন্য একটি ইতিবাচক ও উৎসাহব্যঞ্জক খবর।
পরিবেশবান্ধব বাহন হিসেবে সাইকেল সারা পৃথিবীতেই জনপ্রিয়। একই সঙ্গে এটি স্বাস্থ্যসম্মত ও সাশ্রয়ী। এ ছাড়া নগরে যানজটের ভোগান্তি থেকে বাঁচতেও সাইকেলের জুড়ি নেই। আর বর্তমান করোনা প্রেক্ষাপটে গণপরিবহন এড়াতে সাইকেল হতে পারে ব্যক্তিগত বন্ধুবাহন। অবশ্য নগরে স্বাস্থ্যসচেতন অনেকেই যাতায়াতে নিয়মিত সাইকেল ব্যবহার করছেন।
বিশেষ করে যুবক ও তরুণদের সাইকেল ব্যবহারে আগ্রহ বেশি লক্ষণীয়। আসলে ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ এবং গতিশীল যান্ত্রিক সমাজে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস দিতে পারে যেন এই দুই চাকার সাইকেল। পৃথিবীর অনেক আধুনিক দেশ বর্তমানে এই বাহনটিকে বেশ পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। সাইকেল শুধু নগরায়ণের প্রশান্তি নয়, সাইকেল চালকের স্বাস্থ্য উন্নয়নের বিচারেও এর ভূমিকা অপরিসীম।
বিশ্বের বিভিন্ন শহরে, ছোট থেকে বৃদ্ধ সবাই-ই সাইকেল চালিয়ে তাদের নিত্যদিনের কাজ সম্পন্ন করছেন। পৃথিবীর অনেক উন্নত শহরে, যেখানে তেল পোড়ানো যানের চাইতে সাইকেল নামক দ্বিযানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব রয়েছে অনেক বেশি।
বিশ্বে নেদারল্যান্ডসে মাথাপিছু সর্বাধিক বেশি সাইকেল ব্যবহার করা হয়। তবে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনকে বিশ্বের সবচেয়ে সাইকেলবান্ধব শহর হিসেবে গণ্য করা হয়। নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক ও জার্মানিতে সবচেয়ে বেশি সাইকেল ব্যবহৃত হয়। এসব দেশে সাইকেল চালানোর জন্য রাস্তার পাশে পৃথক লেন রয়েছে।
তবে ইদানীং জাপান, চীন, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ইত্যাদি বিভিন্ন দেশে ছোট দূরত্ব যাতায়াতের জন্য সাইকেল চালানোতে সরকারিভাবে উৎসাহ দেওয়া ও পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে। অফিসযাত্রী কিংবা স্কুল-কলেজে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগও দিচ্ছে কোনো কোনো শহর।
এসব দেশে সড়ক পরিবহনের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত বাহন হচ্ছে বাইসাইকেল। এটি তৈরি হয়েছে সহজ জ্যামিতিক পদ্ধতিতে, চালককে সড়কের আঘাত থেকে রক্ষা করতে এবং কম গতিতে চালানো সহজ করতে।
এসব দেশে শিশুদের সাইকেল চালানোর দক্ষতা সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়ার জন্য অনেক স্কুল ও পুলিশ ডিপার্টমেন্ট শিক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে, বিশেষ করে তাদের সড়কের নিয়মকানুনগুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেওয়া হয়, যেহেতু তারা সাইক্লিস্ট হওয়ার জন্য ইচ্ছা পোষণ করে। বয়স্ক সাইক্লিস্টদের শিক্ষা দেওয়ার জন্যও কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আছে।
ডেনমার্ক বিশ্বের অন্যতম একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ। ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন শহরকে বলা হয়ে থাকে দুই চাকার যানের জন্য এক আদর্শ শহর। বর্তমানে কোপেনহেগেন বিশ্বব্যাপী সাইকেলবান্ধব শহর হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। শহরের পৌরসংস্থার এক তথ্যমতে, শহরের প্রায় ৪১ শতাংশ নাগরিক যাতায়াতের জন্য সাইকেল ব্যবহার করে থাকে।
ড্যানিশরা খুবই পরিবেশ সচেতন। আর পরিবশের দূষণ রোধে সাইকেল সংস্কৃতি তাদের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। পরিবেশকে সবুজ রাখা এবং নিজেদের শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য ডেনমার্কের অধিবাসীরা শিশু বয়স থেকেই সাইকেল চালানো শুরু করে।
একইভাবে নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডাম আরেকটি সাইকেলবান্ধব শহর হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত। নেদারল্যান্ডসের সবচেয়ে জনবসতিপূর্ণ শহর এটি। শহরের প্রায় ৩৮ শতাংশ মানুষের যাতায়াতের বাহন হিসেবে প্রথম পছন্দ সাইকেল। আমস্টারডামের মোট জনসংখ্যার চেয়ে সাইকেলের সংখ্যা অনেক বেশি এবং এখানে ৭ লাখ লোকের মধ্যে সাইকেলের সংখ্যা প্রায় ৮ লাখ।
কানাডার মন্ট্রিয়াল শহরে প্রায় ছয়শো কিলোমিটার সাইকেল চালানোর জন্য আলাদা রাস্তা রয়েছে, যা ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে সাইকেলের জন্য রাখা রাস্তার চেয়ে দুই গুণ।
এসব শহরে প্রতি বছর সাইকেল লেনগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের অনেক অর্থ খরচ করা হয়, যাতে আরোহীরা নিরাপদে সাইকেল চালাতে পারে ও উৎসাহিত হয়। বছরের একটি বিশেষ দিনে বেশ জাঁকজমক করে বার্ষিক সাইকেল উৎসব পালন করা হয়, যা পর্যটকদের জন্য এক প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠে।
চীনের সাংগাই শহরে ৪৩৫ মিলিয়নের বেশি মানুষের সাইকেল রয়েছে। পৃথিবীর মধ্যে সাংগাই একমাত্র স্থান, যেখানে প্রতিদিন এত বিপুলসংখ্যক জনগণ সাইকেলের মাধ্যমে তাদের নিজস্ব গন্তব্যে পৌঁছে থাকে। ঘনবসতিপূর্ণ এই শহরের অর্ধেক মানুষ তাদের দৈনন্দিন যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে সাইকেলকেই পছন্দের তালিকায় রাখে।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো সাইকেল নিয়ে আমাদের বাংলাদেশেও বিভিন্ন সংগঠন আছে। এসব সংগঠনের উদ্যোগে মানুষকে সাইকেল ব্যবহারে উৎসাহ জোগাতে বিভিন্ন আয়োজনও করা হয়। এ ছাড়া এসব সংগঠনের সদস্যরা নিয়মিত সাইকেলে যাতায়াতসহ মাঝেমধ্যেই সাইকেল ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে।
তেমনই একটি সংগঠন ঢাকা সাইক্লিং ক্লাব; যেটি ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এরা বিভিন্ন সময় সাইকেলে দেশ ভ্রমণের আয়োজনের মাধ্যমে এ বিষয়ে মানুষকে উৎসাহ দিয়ে থাকে। তবে একসময় আমাদের দেশে প্রত্যন্ত এলাকায় সাইকেল ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হলেও বর্তমানে মোটরসাইকেলের কারণে সাইকেলের ব্যবহার বহুলাংশে কমে যাচ্ছে।
দেশে সাইকেলের সবচেয়ে বেশি দোকান আছে পুরান ঢাকার বংশালে। পরিবেশবান্ধব বাহন হিসেবে বিশ্বজুড়েই বাইসাইকেলের বেশ কদর আছে। আশার কথা হচ্ছে, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) ২৮টি দেশে বাংলাদেশ সাইকেল রপ্তানি করে এবং সাইকেল রপ্তানিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ৩য়। শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে ১ম তাইওয়ান ও ২য় কম্বোডিয়া।
দেশের সাইকেল রপ্তানিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে মেঘনা গ্রুপ আর পাশাপাশি দুরন্ত, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, আলিটা, ফায়ার-ফক্স ও জার্মান বাংলা কোম্পানিও সাইকেল রপ্তানি করে।
আর এ করোনাকালীন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য গণপরিবহনের সবচেয়ে ভালো বিকল্প হিসেবে সাইকেল ব্যবহৃত হচ্ছে। অফিস বা অন্য কোথাও ভ্রমণের জন্য সাইকেল একদিকে যেমন শারীরিক ও মানসিক বিকাশের ভালো বন্ধু, ঠিক তেমনিভাবে এটি পরিবেশের জন্যও উত্তম বন্ধু।
অন্য যানবাহনের ক্ষতিকর ধোঁয়া পরিবেশের যে চরম ক্ষতি করে, সাইকেল তার বিন্দুমাত্র ক্ষতি করে না। সাইকেল চালানো শুধু পরিবেশ দূষণ থেকেই আমাদের রক্ষা করে না, মোটরগাড়ির কান ফাটানো, গগনবিদারী হর্নের আধিক্য থেকেও রক্ষা করে।
সাম্প্রতিক এক পত্রিকার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, করোনাকালীন সামাজিক দূরত্ব বজায় কর্মস্থল বা বাইরে গমনের জন্য দেশে-বিদেশে সাইকেলের উৎপাদন, বিপণন ও বিক্রয় উৎসাহজনক হারে বাড়ছে।
সামাজিক দূরত্ব ও পরিবেশ রক্ষায় এ সুযোগটি আমাদেরও কাজে লাগানো দরকার। সুতরাং আসুন আমরা সামাজিক দূরত্ব ও পরিবেশ বজায় রাখতে সবুজ যানবাহন সাইকেল চালাই এবং করোনা ঝুঁকি থেকে রক্ষার পাশাপাশি পরিবেশও রক্ষা করি।