পরিবেশদূষণে মারাত্মক বিপর্যস্ত গাজীপুর জেলা
পরিবেশদূষণে মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে গাজীপুর জেলা, গাজীপুরে একটি জলাশয়ও দূষণমুক্ত নেই বলে উঠে এসেছে পরিবেশ বিষয়ক গণশুনানীতে। বুধবার দুপুর ১২টার দিকে গাজীপুরের পিটিআই ক্যাম্পাসের শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার অডিটোরিয়ামে গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
পরিবেশবাদী সংগঠন বেলা, নদী পরিব্রাজক দল, সিএএফওডি, সুইডেন স্ভেরিজ এর আয়োজনে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ‘পরিবেশ দূষণে বিপর্যস্ত গাজীপুর’ শিরোনামে শুনানিতে বেলা’র প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের পরিচালনায় প্রধান অতিথি ছিলেন গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান।
বক্তব্য রাখেন গাজীপুর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রীণা পারভীন, ভাষা শহীদ কলেজের অধ্যক্ষ মুকুল কুমার মল্লিক, বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মনির হোসেন।
জলাশয়গুলো সংকুচিত হওয়া, দখল হওয়া, কারখানা ও গৃহস্থালী বর্জ্য ফেলা, বনের জমিতে কলকারখানা, বসতবাড়ি, পার্ক নির্মাণসহ নানা কারণে দূষণের এসব ঘটনা ঘটছে বলে মন্তব্য করেছেন অংশ নেওয়া বিভিন্ন কমিউনিটির মানুষ।
ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজের অধ্যাপক অসীম বিভাকর বলেন, ‘গাজীপুরের পরিবেশ স্বাভাবিক করতে হলে জনগণের অংশগ্রহণে প্রশাসনের নিয়মিত মনিটরিং, আইনের যথাযথ প্রয়োগ ঘটাতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ কৃষিজমিতে কলকারখানা ও বাড়িঘর নির্মাণ করা যাবে না। শিল্পায়ন যেমনভাবে অর্থনীতির জন্য ভূমিকা রাখে তেমনি পরিবেশ দূষণ বন্ধ করাও অর্থনীতির জন্য অন্যতম সহায়ক।’
গাজীপুর ইতিহাস ঐতিহ্য উন্নয়নে’র চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. শামসুল হক বলেন, কাগজপত্রে গাজীপুরের জনসংখ্যা দেখানো হয় ২৬ লাখ।
এই জনগোষ্ঠীর বর্জ্যের জন্য প্রতিদিন ৭০ শতক জায়গার প্রয়োজন। অথচ এখন পর্যন্ত অপরিকিল্পতভাবে সড়ক ও জনপথের জায়গায় দিনের পর দিন বর্জ্য ফেলে যাচ্ছে সিটি করপোরেশন।
নদী পরিব্রাজক দলের গাজীপুরের সভাপতি মোশারফ হোসেন বলেন, মোগরখালের পাড়ে মাদ্রাসা, মসজিদসহ স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। মোগরখালটি ৯টি গ্রামের মধ্যে প্রবাহিত।
খালের দুই পাশে ২০টি গ্রামের উপকারভোগী মানুষ রয়েছেন। হাজার হাজার একর জমি আবাদ হয় খালের পানি দিয়ে। যদিও আমরা এখন আর কৃষিজমি আবাদ করতে পারছি না।
শ্রীপুর উপজেলা নদী পরিব্রাজক দলের সাধারণ সম্পাদক মো. খোরশেদ আলম বলেন, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পরিবেশ দূষণরোধে পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজন কখনো ভূমিকা রাখতে যায়নি।
শ্রীপুর পৌর এলাকায় গার্মেন্টসসহ একাধিক কারখানা দিনের পর দিন রাসায়নিক বর্জ্যে পরিবেশ দূষণ করছে। নাম্বারবিহীন ড্রাম ট্রাক দিয়ে কলকারখানার বর্জ্য দিনে অথবা রাতে শ্রীপুরের লবণদহ খালের গড়গড়িয়া মাস্টারবাড়ী ব্রিজ থেকে ফেলা হয়।
মুলাইদ এলাকার কেমিক্যাল কারখানার বর্জ্য নিয়মিত ওই খালে ফেলা হচ্ছে। শুধু একটি নয়, টঙ্গী থেকে ময়মনসিংহের ভালুকা পর্যন্ত যতগুলো ক্যামিক্যাল কারখানা রয়েছে সবগুলোর বর্জ্য শ্রীপুরের গড়গড়িয়া মাস্টারবাড়ী লবণদহ ব্রিজ থেকে ফেলা হচ্ছে। এটি প্রতিরোধ করতে হবে।
তিনি বলেন, ৮৩টি রেইনট্রি কড়ই গাছ রোপনের পর ৫৩টি গাছ বেঁচেছিল। পরে বিষাক্ত দূষনে সবগুলো গাছ মারা যায়।
সাহাপাড়ার বাসিন্দা কাজী বদরুত আলম মনির বলেন, গাজীপুর শহরের জোড়পুকুর, সিটি করপোরেশন ভবনের উত্তর পাশের পুকুর, ফায়ার সার্ভিস অফিস সংলগ্ন টাঙ্কিরপাড়া পুকুর, কালীবাড়ী পুকুর, রাণী বিলাসমনি পুকুরের মধ্যে বেশ কয়েকটি দখল এবং কিছু মৃতপ্রায় হয়ে উঠেছে।
জেলে আব্দুল খালেক বলেন, আগে গাজীপুরের জলাশয়গুলো থেকে মাছ ধরে বিক্রি করে সংসার চালাতাম। এখন এসব জলাশয়ে মাছ পাওয়া যায় না। পেশাও পরিবর্তন করতে পারছি না। খুব দুঃখ কষ্টে দিনাতিপাত করছি।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক শুনানীতে অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করে বলেন, জেলায় সরকারের একজন প্রতিনিধি হিসেবে তার অনেক দায় রয়েছে।
গত ত্রিশ বছরে গাজীপুরে অর্থনৈতিক ট্রান্সফরমেশন হয়েছে। আগে জলাশয়ের যে প্রবাহ খাল বিলে ছিল এখন আর নেই। তার সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে দোষীদের নিবৃত করার চেষ্টা করেছেন। মোগরখালের একটি অংশে ব্যক্তিগত জায়গা রয়েছে। আমরা সেটি খুলে দিতে পারিনি।
একটি গণমাধ্যমের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের ২০৬টি পুকুর বেদখল হয়ে গিয়েছিল। সেখানে ইতোমধ্যে আমরা ৮টি পুকুর উদ্ধার করেছি।
আমার কাছে এনফোর্স করার মতো সুযোগ রয়েছে কিন্তু সাসটেইন করার মতো বাজেট আমার কাছে নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে মিটিং করে সব পুকুর একটি প্রকল্পের আওতায় এনে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি।
জেলা প্রশাসন হাজার হাজার ইস্যু নিয়ে কাজ করছে। সেখানে সাসটেইন করার দায়িত্ব তিনি জনসাধারণকে নেয়ার আহবান জানান। মানুষের সম্পৃক্ততা ছাড়া গাজীপুরের সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।