সামুদ্রিক রোগ কি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে? পৃথিবী উষ্ণায়নে পরজীবী জীবাণুর প্রাদুর্ভাব কেমন ঘটবে?
মূল লেখক: Dan Dinicola, University of Washington
রূপান্তর: দীপক কুন্ডু

উষ্ণায়নের ঘটনাসমূহ মাত্রাগত ও তীব্রতার দিক থেকে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বিশ্বব্যাপী বাস্তুতন্ত্রকে (Ecosystems) হুমকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রার পারদ যদি এভাবে চড়তে থাকে, তাতে পরজীবী জীবাণু এবং রোগের সম্পর্ক, প্রাদুর্ভাব ও ছড়িয়ে পড়ার মতো অনিশ্চয়তা আরও বেড়ে যাবে।
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরজীবী জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকির বিষয়ে অনুসন্ধান করা হয়েছে, যেখানে রোগ সংক্রমণ সম্পর্কে গবেষকদের জন্য নতুন করে ভাববার নানাবিধ অনুষঙ্গ বেরিয়ে এসেছে। গবেষণাপত্রটি এবছর ১৮ মে Trends in Ecology and Evolution সাময়িকী-তে প্রকাশিত হয়েছে।
এই সমীক্ষা পূর্ববর্তী একটি গবেষণার উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে পরজীবী-বাহকের সম্পর্ক (parasite-host relationship) নিয়ে- প্রায় দুই দশকের নতুন নতুন তথ্য প্রমাণ যুক্ত করে একটি কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে।
ঐতিহ্যগতভাবে, জলবায়ু সংক্রান্ত গবেষণা দীর্ঘ সময় ব্যাপী করা হয়। তবে এই অসাধারণ পদ্ধতির মাধ্যমে উষ্ণায়নের বৃদ্ধির ঘটনা কিভাবে ক্রমবর্ধমান ভাবে পরজীবী জীবাণু সংক্রমণের ধারাকে ক্রমাগত পরিবর্তন করে তা পরীক্ষা করা হয়।
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ অ্যাক্যাটিক অ্যান্ড ফিশারি সায়েন্সেস বিভাগের পোস্টডক্টরাল গবেষক, মুখ্য লেখক ড্যানিয়েল ক্ল্যার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জীবদেহ ও বাস্তুতন্ত্রে (Ecosystems) কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে, সে সম্পর্কে যতটুকু জানা যায় তাতে বেশিরভাগই ধীরে ধীরে উষ্ণায়নরে প্রতি আলোকপাত করা হচ্ছে।
আর জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সময়ের সাথে সাথে শুধু উষ্ণতা বৃদ্ধি পায় না, বরং তাপ প্রবাহের মতো চরম ঘটনার পৌনঃপুনিকতা ঘটে ও মাত্রা বাড়ায়।”
ক্ল্যার ব্যাখ্যা করেন যে, ক্রমাগত উষ্ণায়ন এবং উষ্ণায়নের হ্রাস-বৃদ্ধি উভয়ই বাস্তুতন্ত্র (Ecosystems) প্রভাবিত করতে পারে এবং প্রভাব ফেলতে পারে, তবে তা বিভিন্ন উপায়ে করে।
জৈবদেহ ধীরে ধীরে উষ্ণায়নের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে এবং গতি বজায় রাখতে সক্ষম হতে পারে তবে উষ্ণায়নের তীব্র অস্থিরতার ঘটনাটি আকস্মিক এবং গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।

২০১৩-২০১৫ সালের “ব্লব” এমনই একটি উষ্ণায়নের তীব্র অস্থিরতার ঘটনা যার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল জুড়ে সামুদ্রিক তারামাছের ব্যাপক মহামারী দেখা দেয়।
বিশাল সূর্যমুখী সামুদ্রিক তারামাছসহ অনেক প্রজাতির সামুদ্রিক তারামাছ আকস্মিক বিনাশকারী এক রোগের মহামারীতে বিলুপ্তপ্রায় হয়ে পড়েছিল। পাঁচ বছর পরেও, এই অঞ্চলে সেগুলি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
ব্লব – এর সঙ্গে যুক্ত অস্বাভাবিকভাবে উষ্ণ জলরাশির মধ্যে ডেনসোভাইরাস সামুদ্রিক তারামাছকে আক্রান্ত করবার অনুকূল পরিবেশ পেয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
এই সামুদ্রিক রোগের প্রকোপকে লেখকগণ ক্রমবর্ধমান জোয়ারের ধাবমানতা বা ভাটার টান কিংবা সুনামির সাথে তুলনা করেছেন। রোগের সংক্রমণ হ্রাস-বৃদ্ধির ক্ষেত্রে- ক্রমাগত উষ্ণায়ন বা ধারাবাহিক অস্থিতিশীল উষ্ণায়নের ঘটনাসমূহ সমবেত ভাবে ভূমিকা রাখে।
যাইহোক, রোগের প্লাবন বা খরার মত যেকোনোটির সূচনার মধ্য দিয়ে, একটি তীব্র অস্থিতিশীল উষ্ণায়নের ঘটনায় মহামারী সুনামির রূপ ধারণ করতে পারে, যেমন প্রশান্ত মহাসাগরীয় উত্তর-পশ্চিম জুড়ে সামুদ্রিক তারামাছের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়েছিল।
তবে, উষ্ণায়ণের সব উত্থান-পতন একই প্রতিক্রিয়া দেখায় না। একটি নির্দিষ্ট পরজীবী জীবাণু বা তার বাহক একটি বিশেষ অবস্থায় উপকৃত হতে পারে, আবার আরেকটি ভিন্ন অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্তও হতে পারে।
উষ্ণায়ন একটি পরজীবীর জীবনচক্রে পরিবর্তন আনতে পারে, জীবাণু তার উপযুক্ত বাহক প্রজাতির জীবন পরিসর কমিয়ে দিতে পারে বা বাহক প্রাণীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও হ্রাস করতে পারে।
কিছু ফ্ল্যাটওয়ার্ম (flatworms) যা বন্যপ্রণী এবং মানুষকে রোগাক্রান্ত করে সেগুলি গরম জলে বেশি দিন বাঁচতে পারে না এবং তাদের বাহককে সংক্রামিত করবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
অপর সাম্প্রতিক ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, সাধারণভাবে সুশি’তে (জাপানী খাবার)পাওয়া পরজীবীর সংখ্যা গত ৪০ বছরে ২৮৩ গুণ বেড়েছে, যদিও উষ্ণায়নের অস্থিতিশীল আচরণ এবং এই জীবাণুর ব্যাপক বৃদ্ধির মধ্যে কি সম্পর্ক তা এখনও স্পষ্ট নয়।
ক্ল্যার বলেন, ” বাহক, পরজীবী এবং তাদের সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ক জটিল এবং বহুবিধ কারণের উপর নির্ভরশীল, এবং ফলাফলের ব্যাপারে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন”।
তিনি গবেষকদের তাদের ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে প্রত্যেকটি বিষয় ধরে ধরে গবেষণা করে তার ভিত্তিতে ভবিষ্যদ্বাণী করার পরামর্শ দেন।
লেখকরা এভাবে উপসংহারে পৌঁছেছেন যে, গবেষকদের সরাসরি জোয়ারের পূর্বাভাস এর পরিবর্তে কনে একটি শান্ত সমূদ্র হঠাৎ ভয়ংকর হয়ে উঠে – তাতে উষ্ণায়নরে গভীরতা পর্যবেক্ষণ করা।
ক্লার বলেন, “এটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ যে, আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে পরজীবী জীবাণু এবং রোগ কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে তা অনুধাবন এবং ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম হয়েছি।
তাই মানুষ ও বন্যপ্রাণীর স্বাস্থ্যের উপর এগুলোর সম্ভাব্য প্রভাব নিরুপণ এবং প্রশমন করতে আমাদের প্রস্তুতি গ্রহণ করা অতি আবশ্যক হয়ে পড়েছে।”