Dr. A K M Nazrul Islam (ড. নজরুল ইসলাম)
Associate Professor of Environmental Economics at Dhaka School of Economics
বন্ধুরা, আমার বর্তমান কর্মস্থল, আমার প্রিয় প্রতিষ্ঠান ‘ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকস’ (Dhaka School of Economics) নিয়ে প্রায় প্রতিনিয়তই আমাকে অনেক প্রশ্ন শুনতে হয়। যেমন, এই প্রতিষ্ঠানকে কেন ‘স্কুল’ বলা হয়, এর শিক্ষা কার্যক্রম কি, এটি কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠান কি না, ইত্যাদি। আজকে আমি আপনাদের জন্য ‘ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকস’-এর জন্ম, কেন এই প্ৰতিষ্ঠান, তার শিক্ষা-কার্যক্রম কি, ইত্যাদি নিয়ে কিছু তথ্য উপস্থাপন করতে চাই:
(১) বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই ‘লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক এন্ড পলিটিকাল সাইন্স’ কিংবা ‘দিল্লি স্কুল অব ইকোনমিকস’-এর আদলে বাংলাদেশে অর্থনীতিতে উচ্চ-শিক্ষার একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য অনেকবার চিন্তা-ভাবনা করা হলেও বিভিন্ন কারণে তা ২০১০ পর্যন্ত সম্ভব হয়ে উঠেনি।
(২) ২০১০ সালে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির তৎকালীন সভাপতি এবং দেশের বরেণ্য অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ- এর নেতৃত্বে এবং বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সার্বিক তত্ত্বাবধানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে ‘ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকস‘ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে। প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেন রোড এর ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি’ এবং ‘সুইড বাংলাদেশ’-এ তার শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। অতি-শীগ্রই ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকস তার নিজস্ব ক্যাম্পাস, রাজধানীর পূর্বাচলে স্থানান্তরিত করার আশা রাখে।
(৩) ২০১২ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি স্নাতকোত্তর পর্যায়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তার শিক্ষা-কার্যক্রম শুরু করে। শুরুতে অর্থনীতিতে একটি ‘স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা’ এবং ‘পরিবেশ অর্থনীতি’-তে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তীতে, উন্নয়ন অর্থনীতি এবং উদ্যোক্তা অর্থনীতিতে আরো দুইটি স্নাতকোত্তর ডিগ্রী শুরু করে।
(৪) বিশ্ব অর্থনীতির দ্রুত পরিবর্তনশীল এই সময়কে সামনে রেখে দেশে অর্থনীতির অতি-বিশেষায়িত ক্ষেত্রে ক্রম-বর্ধমান চাহিদা মেটানো এবং দেশের অর্থনীতির অভিঘাত মোকাবেলা এবং সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার -কল্পে ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকস স্নাতকোত্তর ডিগ্রীর পাশাপাশি স্নাতক-পর্যায়ে ইতোমধ্যে তিনটি বিশেষায়িত ডিগ্রী শুরু করেছে: (ক) ‘পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ অর্থনীতি’, যা ২০১৫-১৬ শিক্ষা-বর্ষ থেকে শুরু হয়েছে; (খ) ‘উন্নয়ন অর্থনীতি’, যা ২০১৮-১৯ সেশন থেকে শুরু হয়েছে; এবং (গ) উদ্যোক্তা অর্থনীতিতে বর্তমান সেশন থেকে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি শুরু করেছে। অদূর ভবিষ্যতে অর্থনীতির অন্যন্য বিশেষায়িত শাখায় প্রতিষ্ঠানটি স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং গবেষণা-ধর্মী ডিগ্রী শুরু করার ইচ্ছা রাখে।
(৫) চলতি শিক্ষা-বর্ষে (2019-20) প্রতিষ্ঠানটি উপরোক্ত তিনটি বিশেষায়িত বিষয়ে: (ক) ‘পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ অর্থনীতি’, (খ) ‘উন্নয়ন অর্থনীতি’, এবং (গ) ‘উদ্যোক্তা অর্থনীতি’তে স্নাতক-পর্যায়ে ভর্তির কার্যক্রম শুরু করেছে। আগ্রহীগন আগামী ১৭ নবেম্বর পর্যন্ত এই তিনটি বিষয়ের জন্য নির্ধারিত ফর্মে আবেদন করতে পারবেন। ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে আগামী ২২ নবেম্বর এবং বাছাইকৃতদের মধ্য থেকে চূড়ান্ত বাছাইয়ের জন্য ২৩ নবেম্বর ইন্টারভিউ করা হবে।
কোন দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে ত্বরান্বিত করতে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাপ্যতা এবং তার সঠিক ব্যবহার একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রাকৃতিক সম্পদ বা প্রাকৃতিক পুঁজি কোন দেশের অর্থনীতিতে মূলত দুইটি বড় ভূমিকা পালন করে থাকে: উৎপাদনে কিংবা ভোগে নিয়মিত যোগান দেয়া আর উচ্ছিষ্ট পরিপাকের মাধ্যমে আমাদের পরিবেশকে পরিষ্কার রাখা।
সময়ের সাথে সাথে মানব সভ্যতার বিকাশ এবং তথ্য, উৎপাদন আর ভোগের বিশ্বায়নের মাধ্যমে মানুষের অর্থনৈতিক কর্ম-কাণ্ডের সম্প্রসারণ, ভোগ আর চাহিদার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি, এবং অনেকাংশেই তার অযুক্তিক উৎপাদন এবং ভোগ-বিলাসিক আচরণ তাকে একটি অসম সমাজ-ব্যবস্থার দিকেই নিয়ে যাচ্ছে না, বরং অনেক ধরণের সাময়িক এবং দীর্ঘ-মেয়াদি সমস্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যেমন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন, অরণ্যবিনাশ, জলাভূমি ধ্বংস, পানি-বায়ু-শব্দ দূষণ, ইত্যাদি আজকের মানব-সমাজের কিছু দৈনন্দিন সমস্যার উদাহরণ। আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে প্রাকৃতিক সম্পদের গুরুত্ত্ব সুবিশেষ।
সেই অতি গুরুত্ত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ আজ বিভিন্ন কারণে ধ্বংসের পথে। তার অন্যতম প্রধান কারণ হলো প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক তথ্য না থাকা, তাদের অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্পর্কে আমাদের সঠিক জ্ঞান না থাকা, বাজারমূল্যের অভাব, অনেক ক্ষেত্রে বিনামূল্যে অধিরোহণসহ নানাবিধ কারণে প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার আজ দ্রুত নিঃশ্বেষিত হবার পথে। প্রকৃতিক সম্পদের এই দ্রুত এবং অর্বাচীন নিঃশেষকরণ শুধু আমাদের অর্থনীতিকে সামনের দিনগুলোতে ঝুঁকিতে ফেলে দিবে না, বরং সমাজের অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল এবং প্রাকৃতিক সম্পদ-নির্ভর একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
সুষ্ঠু বিশ্ব-অর্থনীতি এবং মানব সভ্যতার স্বার্থে এই পরিবেশ-বিরাগপূর্ণ উৎপাদন-ভোগ ব্যবস্থাকে দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। আর সেই জন্য প্রথমে দরকার পরিবেশকে চেনা, জানা এবং তার ধারকত্ব সম্পর্কে পুরাপুরি জ্ঞান আহরণ করা। কার্যকর নীতি-নির্ধারণ, সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতকরণ এবং তাদের অনাকাঙ্খিত রিক্তকরণ বন্ধ-কল্পে প্রাকৃতিক সম্পদকে সঠিকভাবে জানা, ভোক্তার চাহিদা এবং তার পরিসীমা সম্পর্কে সঠিক ধারণা পোষণকরা এবং সেই অনুযায়ী সম্পদ ব্যবহার-নিশ্চিতকরণ অতি জরুরি।
সেই জন্য চাই, দক্ষ মানব-সম্পদ।
সেই মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এবং আগমনী দিনগুলোতে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে নানাবিধ অভিঘাত মোকাবেলায়, ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে ‘পরিবেশ অর্থনীতি’তে দক্ষিণ এশিয়ায় সর্ব-প্রথম নিয়মিত মাস্টার্স প্রোগ্রামে শুরু করে। এই প্রোগ্রামটি শুরু থেকেই অভিভূতকারী সাড়া পেয়ে থাকে। ২০১৯-২০ শিক্ষা বছরে এই প্রোগ্রামের আওতায় ৯ম ব্যাচ-এর ক্লাস গতমাসে শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে, ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকস একটি অতি বিশেষায়িত স্নাতক প্রোগ্র্যাম: “ব্যাচেলর অব ইকোনমিকস ইন এনভায়রনমেন্টাল এন্ড রিসোর্স ইকোনমিকস” শুরু করেছে, যার আওতায় এ বছর প্রতিষ্ঠানটি তার ৫ম ব্যাচের ভর্তি কার্যক্রম শুরু করেছে।
যতটুকু জানা যায়, এই স্নাতক প্রোগ্রামটি অন্য-কোন দক্ষিন এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় এখনও শুরু করেনি। ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকস এর ‘পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ অর্থনীতি বিভাগ’টি দক্ষিন এশিয়ার সর্ব-প্রথম এই বিষয়ে বিশেষায়িত একটি বিভাগ। তিনজন পিএইচডি ধারীসহ বিভাগটিতে রয়েছে মোট ৮জন শিক্ষক, যারা সবাই পরিবেশ অর্থিনীতে উচ্চ-শিক্ষিত। পরিবেশ অর্থিনীত বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে বই, গবেষণা রিপোর্ট, জার্নাল-এর বিশাল সংগ্রহ।