ঢাকায় বিশ্ব বাইসাইকেল দিবস- ২০২৪ উদযাপন এবং বনাঢ্য সাইকেল র্যালী অনুষ্ঠিত
গত ৩রা জুন ছিল বিশ্ব বাইসাইকেল দিবস।
বাইসাইকেল একটি সহজ, সাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য, পরিচ্ছন্ন এবং পরিবেশগতভাবে উপযুক্ত টেকসই পরিবহনের মাধ্যম। ইহা স্বতন্ত্র, টেকসই, দীর্ঘায়ু এবং ব্যবহারে বহুমূখীতার কারণে বিগত দুই শতাব্দি হতে সাধারণ মানুষের যান হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
মানুষের চলাচলের যান হিসাবে যুগ হতে যুগান্তরে বহু যান আববিস্কৃত হয়েছে আবার যুগের বিবর্তণে নতুন নতুন যান আবিস্কার ও উন্নতকরনের ফলে পুরানো সব যান হারিয়ে গেছে -একমাত্র বাইসাইকেলই তার ব্যতিক্রম। বাইসাইকেলেই একমাত্র যান যা আবিস্কারের পর গত দু শতাব্দি ধরে মানব যান হিসাবে তার স্থান অটুট রয়েছে।
এতদিনেও এ যানটির জনপ্রিয়তা ও ব্যবহার একটুতো কমেনি বরং দিনের পর দির এর জনপ্রিয়তা, ব্যবহার ও বহুমূখিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরই স্বীকৃর্তি হিসাবে ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ৩ জুনকে বিশ্ব বাইসাইকেল দিবস হিসাবে ঘোষণা করেছে।
এ দিবসটি পতিপালনের লক্ষ্য সাইকেল চালানোর বিভিন্ন সুবিধা প্রচার করা, যার মধ্যে শিক্ষাকে শক্তিশালী করা, ধৈর্যের প্রচার করা, রোগ প্রতিরোধ করা, শারীরিক ব্যায়ামকে উৎসাহিত করা এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তি সহজতর করা। বর্তমান যান্ত্রিক ও অনলাইন মিডিয়ার যুগে শারীরিক ক্রিয়াকলাপের স্থান ও সুযোগের অভাব, পরিবেশ দূষণ এবং এর সাথে সম্পর্কিত স্বাস্থ্যের ঝুঁকির বিষয়ে ক্রমবর্ধমান উদ্বোগকে প্রশমিত করার ক্ষেত্রে সাইক্লিং অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে।
পরিবহণের একটি পরিষ্কার, সাশ্রয়ী মূল্যের এবং পরিবেশগতভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ ইহা একটি সহজ যান। বিশ্ব বাইসাইকেল দিবস প্রতিপালন স্বাস্থ্য এবং পরিবেশগত উভয় সমস্যাকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করে, পরিষ্কার বায়ু এবং প্রকৃতির সংরক্ষণে সহায়তা করতে বা্সাইকেলের ব্যবহারকে উৎসাহিত করে।
এই বছর বিশ্ব বাইসাইকেল দিবসের প্রতিপ্রাদ্য হল “সাইকেল চালানোর মাধ্যমে স্বাস্থ্য, সমতা এবং টেকসইতাকে উদ্ভূদ্ধ করণ (Promoting Health, Equity, and Sustainability through Cycling)।”
সারা বিশ্বের মত বাংলাদেশেও এ দিবসটি পালন উপলক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন পরিবেশ ও সামাজিক সংগঠণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাইসাইকেল রাইডিং সংগঠণ, বাইসাইকেল রাইডারগণ সকাল ৭-৩০ ইমনিটে রাজধানীর ডানমন্ডির আবাহনী খেলার মাঠে একত্রিত হন এবং সংক্ষিপ্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। আলোচনা শেষে আবাহনী মাঠ থেকে ধানমন্ডি ৩/এ সড়ক হয়ে শংকর বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত একটি বনাঢ্য বাইসাইকেল র্যালী অনুষ্ঠিত হয়।
এ দিবসটি পালনে যে সকল প্রতিষ্ঠান আলোচনা ও র্যালীটির আযোজন করে সেগুলো হ’ল রায়ের বাজার উচ্চ বিদ্যালয়, ঢাকা আইডিয়াল ক্যাডেট স্কুল, ধানমন্ডি কচিকন্ঠ হাই স্কুল, বেঙ্গলী মিডিয়াম হাই স্কুল, কনফিডেন্স মেমোরিয়াল হাই স্কুল, ধানমন্ডি ট্যুরিজম সাইক্লিস্ট, ছায়াতল বাংলাদেশ, ফিমেল সাইকেলার্স অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ সাইকেল লেন বাস্তবায়ন পরিষদ, সূর্য শিশির রানার্স কমিউনিটি, লাল সবুজ সোসাইটি, হেলদি লিভিং, ইনস্টিটিউট অব ওয়েলবীইং বাংলাদেশ এবং ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট। বিশ্ব বাইসাইকেল দিবস-২০২৪ এর প্রতিপ্রাদ্যের পাশাপাশি বাংলাদেশে দিবসটি পালনে “শীতলতর শহরের জন্য সাইক্লিং (Cycling for Cooler Cities“ শীর্ষক কর্মসূচীও পালন করা হয়।
বাংলাদেশসহ সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবছর প্রচন্ড তাপদাহে পুড়ছে। বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা তীব্র দাপদাহে মানুষের সীমাহীন ভোগান্তী, দূদর্শা মানবজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে এবং এখনও এসব অহ্চল তাপদাহে ঝলছে। বিশেষ করে এর প্রভাব শহরাঞ্চলে অত্যাধিক। আর শহরাঞ্চলে এর জন্য দায়ী জীবাস্ম জ্বালাণী চালিত মোটর যান।
বিগত কয়েক দশকে নগর এলাকার তাপমাত্রা অসহনীয়ভাবে বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ মোটর যানবাহনের উপর মাত্রারিক্ত নির্ভরশীলতা এবং এর কারণে গ্রীণহাউজ গ্যাসের নির্গমন বৃদ্ধি। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ঢাকা শহরে শুধুমাত্র একদিন ব্যক্তিগত গাড়ির পরিবর্তে বাইসাইকেল ব্যবহার করা হলে কার্বন নির্গমন ৬৭% পর্যন্ত কমানো সম্ভব। নগরে বাইসাইকেলে যাতায়াতের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য রক্ষার পাশাপাশি দূষণ, যানজট, দুর্ঘটনা, শহরে তাপমাত্রার প্রভাব কমিয়ে আনাসহ এতদসংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা মোকাবেলা করা সম্ভব হবে।
ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টে’র পরিচালক গাউস পিয়ারী’র সভাপতিত্বে এবং সংস্থার সহকারি প্রকল্প কর্মকর্তা মোঃ মিঠুন এর সঞ্চালনায় আনুষ্ঠিত আলোচনায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৩৪ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শেখ মোহাম্মদ হোসেন খোকন।
শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন দি ইনস্টিটিউট অব ওয়েলবীইং বাংলাদেশ এর কমিউনিকেশন অফিসার মাহামুদুল হাসান। আরও বক্তব্য রাখেন ঢাকা আইডিয়াল ক্যাডেট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা এম এ মান্নান মনির, ধানমন্ডি কচিকন্ঠ হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক এইচ এম নুরুল ইসলাম, বেঙ্গলী মিডিয়াম হাই স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক মো: জাকির হোসেন, কনফিডেন্স মেমোরিয়াল হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো: দেলোয়ার।
এ ছাড়াও অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সাইকেল লেন বাস্তবায়ন পরিষদের সভাপতি মো: আমিনুল ইসলাম টুব্বুস, লাইফ সার্ভ বাংলাদেশের আজাদ হোসেন, হেলদি লিভিং-এর সদস্য মৌসুমি আক্তার বাঁধন, গ্লোবাল ফার্মা’র ডিরেক্টর এবং সিইও একেএম আহসান উল্লাহ, ফিমেল সাইকেলার্স অব বাংলাদেশ-এর সিফাত হারুনসহ আরো অনেকে উপস্থিত ছিলেন। আয়োজনে প্রায় শতাধিক সাইক্লিস্ট অংশগ্রহণ করেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৩৪ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শেখ মোহাম্মদ হোসেন খোকন বলেন, কার্বন নিঃসরণ বিশ্বব্যাপী এক মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাইসাইকেল এমন একটি বাহন যার জন্য জীবাশ্ম জ্বালানীর প্রয়োজন হয় না। সাধারণত একটি মোটরযান বছরে প্রায় ৫ মেট্রিক টন কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন করে। নগরে বাইসাইকেল ব্যবহারের মাধ্যমে কার্বন নির্গমনের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনা সম্ভব।
অন্যান্য বক্তারা বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়ন, অতিরিক্ত যানবাহনের ব্যবহার নগর এলাকায় তাপমাত্রা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। স্বল্প দূরত্বেও মোটরযান ব্যবহার করায় প্রচুর পরিমাণে গ্রীণহাউজ গ্যাস তথা কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং ওজোন নির্গত হচ্ছে। ইতোমধ্যে ঢাকা মেট্রোতে নিবন্ধিত ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ৩,৪২,৭৪৪টিতে উন্নীত হয়েছে। এ সংখ্যার আরো বৃদ্ধি ঢাকা শহরের তাপমাত্রা আরো অসহনীয় হয়ে উঠবে।
বিগত ১০ বছরে ঢাকার তাপমাত্রা বেড়েছে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা এভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকলে নগরজীবনে বসবাস অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে। তাই বিপর্যকর পরিবেশ প্রতিরোধের লক্ষ্যে এখনই নগর এলাকায় জীবাস্ম জ্বালাণী চালিত মোটর যান ধীরে ধীরে হ্রাস করে বাইসাইকেল এর ব্যবহার বৃদ্ধির কমসূচি গ্রহন করা অত্রন্ত প্রয়োজন।
বক্তারা আরো বলেন, ঢাকা শহরে তরুণদের মধ্যে ব্যপক বাইসাইকেলের জনপ্রিয়তা রয়েছে। ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (২০১৬-২০৩৫) অনুযায়ী, ঢাকা শহরে প্রতিদিন প্রায় ২ লক্ষ মানুষ বাইসাইকেলে যাতায়াত করে।
কিন্তু বাইসাইকেল বান্ধব অবকাঠামো তথা বাইসাইকেল পার্কিং ব্যবস্থা, আলাদা বাইসাইকেল লেন না থাকায় সাইক্লিস্টদের যেমন রাস্তায় ঝুঁকি নিয়ে সাইকেল চালাতে হচ্ছে, তেমনি নিরাপদ বাইসাইকেল পার্কিং না থাকায় হালকা যানটি চুরি হওয়ার ভয়ে সাইকেলের ব্যবহার আশানুরূপভাবে প্রসার ঘটছে না।
এজন্য স্বল্প ও দূরবর্তী যাতায়াতের জন্য সাইকেলের আলাদা লেন সুবিধাসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ এর মাধ্যমে একটি সমন্বিত বাইসাইকেল বান্ধব নেটওয়ার্ক তৈরির আহ্বান জানানো হয়।
বিশ্ব বাইসাইকেল দিবস ২০২৪ পালন কর্মসূচী হতে আরো যে সকল দাবী উপস্থাপন করা হয়, সেগুলি হ’ল-
সাইক্লিস্টদের জন্য নিরাপদ সড়ক পারাপারের ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ; সাইক্লিস্টদের নিরাপত্তা রক্ষার্থে মোটরযানের গতিসীমা এবং সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ; বাইসাইকেল বান্ধব অবকাঠামো ও বাইসাইকেলের রুট নেটওয়ার্ক তৈরি; সড়ক বিভাজিকার মধ্যে শুধুমাত্র পথচারী ও সাইক্লিস্টদের জন্য ফাঁকা জায়গা থাকা; শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সাইক্লিং এর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা; সাইকেলের উপর কর হ্রাস করা; সাইকেল পার্কিংয়ের জন্য নির্দিষ্ট ও নিরাপদ স্থান চিহ্নিত করা; সাইকেল নেটওয়ার্ক তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ করা; সাইকেল রুট, বাঁক, সড়ক পারাপার, পার্কিং ইত্যাদির জন্য প্রয়োজনীয় সাইন প্রদান করা; ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা অনুযায়ী, দ্রুত ২০২ কি:মি: বাইসাইকেল লেন তৈরির উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়।