ঢাকায় টিকে আছে মাত্র দুই শতাংশ বনভূমি
শতকের পর শতক গেছে। আর ক্রমে কমেছে বনভূমির এলাকা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের গবেষণা বলছে, এখন ঢাকার মাত্র ২ শতাংশ এলাকায় বনভূমি রয়েছে। আর এর ৭০ শতাংশই রয়েছে মিরপুর ও এর আশপাশের এলাকায়। এই বনভূমি এলাকায় বিপন্ন কিছু প্রাণীও রয়েছে বলছে ওই গবেষণা।
জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বনভূমি ব্যবস্থাপনার বিষয়টি দেখভাল করে খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। সংস্থাটি বলছে, কোনো এলাকায় আধা হেক্টরের বেশি গাছ থাকলে এবং তা ৫ ফুটের বেশি হলে এটি বন হিসেবে ধরে নিতে হবে। আর জাতিসংঘের জীববৈচিত্র্য সনদ অনুযায়ী, এসব বনভূমি রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
বনভূমি কতটা কমেছে
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সোমবার প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, ঢাকা মহানগরে ২০ ভাগ সবুজ এলাকা থাকা প্রয়োজন। সেখানে আছে সাড়ে ৮ ভাগের কম। তা-ও এসব এলাকার রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব কোনো এক সংস্থার ওপর নেই।
গবেষণায় দেখা যায়, রাজউক, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, গণপূর্ত অধিদপ্তর, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ ও বিএফডি ঢাকার সবুজ জায়গা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে সবুজ জায়গা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে রাজউকের বিরোধ রয়েছে। আবার সিটি করপোরেশন অনেক ক্ষেত্রে মুনাফা করার জন্য সবুজ জায়গায় বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে। একটির সঙ্গে আরেকটির সমন্বয় নেই। ফলে এসব এলাকার বনভূমি চরিত্র হারাচ্ছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৮৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৩১ বছরে ঢাকার সবুজ বৃক্ষে আচ্ছাদিত এলাকা ৫৬ শতাংশ কমে গেছে। যেসব এলাকাকে বনভূমি বলা যায়, এমন এলাকার পরিমাণ ১৭ শতাংশ থেকে কমে ২ শতাংশে নেমে এসেছে। আর এই ২ শতাংশ বনভূমি ধরনের এলাকাগুলোর প্রায় ৭০ শতাংশ মিরপুর ও এর আশপাশের এলাকায় পড়েছে।
‘প্রেজেন্ট স্ট্যাটাস অ্যান্ড হিস্টোরিক্যাল চেঞ্জেস অব আরবান গ্রিন স্পেস ইন ঢাকা সিটি বাংলাদেশ: আ রিমোট সেনসিং ড্রাইভেন অ্যাপ্রোচ’ শীর্ষক ওই গবেষণা প্রতিবেদনটি গত বছরের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের এনভায়রনমেন্ট চ্যালেঞ্জেস জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
ওই গবেষণা বলছে, মিরপুর ও এর আশপাশেও বনভূমি ধরনের এলাকাগুলো ২০১১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ১ হাজার ৫৬ হেক্টর থেকে কমে ৭৯৪ হেক্টরে নেমে এসেছে।
এ ব্যাপারে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মিরপুর এলাকায় এখনো অনেক উন্মুক্ত স্থান আছে। যেখানে পরিকল্পিতভাবে বৃক্ষরোপণ করে নগর বন তৈরি করা সম্ভব। একই সঙ্গে সেখানে বন্য প্রাণীর বসতি ফিরিয়ে আনা যাবে। তবে তার আগে আমাদের যতটুকু বনভূমি আছে, তা রক্ষা করতে হবে।
টিকে থাকা বনে ২০৯ প্রজাতির প্রাণী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ২০২১ সালে প্রকাশিত ‘স্পাইসেস ডাইভার্সিটি, ডিস্ট্রিবিউশন অ্যান্ড হ্যাবিটেট ইউটিলাইজেশন অব আরবান ওয়াইল্ডলাইফ ইন আ মেগাসিটি অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, টিকে থাকা বনরাজিতেই ২০৯ প্রজাতির বন্য প্রাণী বাস করছে।
২০২১ সালের শেষ দিকে জার্মানির টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব ড্রেজডেনের গবেষক সৌরভ মাহমুদের প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন ‘বার্ডস অব ঢাকা সিটি, দেয়ার হ্যাবিটস অ্যান্ড কনজারভেশন’ বলছে, ঢাকায় ২৪৮ প্রজাতির পাখি বাস করে। তবে এদের সংখ্যা খুব দ্রুতই কমছে।
সৌরভ মাহমুদ বলেন, ঢাকার উদ্যান ও সবুজ এলাকাগুলোকে একখণ্ড ভূমি বা চিত্তবিনোদনকেন্দ্র হিসেবে দেখা হয়। বন্য প্রাণীর বসতি ও খাবার জোগানদাতা হিসেবে এসব এলাকাকে বিবেচনা করা হয় না। ফলে ঢাকায় বসবাসকারী প্রাণীদের অর্ধেকের বেশি প্রজনন করে এর আশপাশের জেলাগুলোতে। ছোটখাটো ঝোপঝাড় বনভূমি ও জলাভূমি রক্ষা গেলে এসব প্রাণী টিকে থাকতে পারবে।
কী করণীয়
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, পৃথিবীজুড়ে এখন নগরগুলোতে বনভূমি রক্ষা ও নতুন করে বনায়ন করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও এ ব্যাপারে জাতিসংঘের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি, ঢাকার উদ্ভিদ উদ্যানগুলোর গাছ কমছে।
ঢাকায় এখনো যেসব বন্য প্রাণী টিকে আছে, তাদের বসবাসের উপযোগী বৃক্ষরোপণ, সড়ক বিভাজনের দুই পাশে গাছ লাগানোর ওপর জোর দেন আইনুন নিশাত।
তিনি বলেন, এমন ধরনের গাছ রোপণ করতে বেশি দেখি, যা বন্য প্রাণীর জন্য উপযুক্ত নয়, বরং তা পড়ে মানুষের এবং শহরের যান চলাচলের সমস্যা হয়। এই শহরের বৃক্ষরাজি ও বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনার জন্য স্বতন্ত্র একটি ব্যবস্থাপনার দরকার বলে মনে করেন তিনি।