ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ প্রাণের অস্তিত্বের হুমকি
পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পরিবেশের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। পরিবেশই প্রাণের ধারক ও বাহক। ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ প্রাণের অস্তিত্বের পক্ষে হুমকি।
মানুষ যেমন তার প্রয়োজনে পরিবেশকে নিজের উপযোগী করছে, ঠিক তেমনি সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতিতে মানুষ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে প্রাণের অস্তিত্ব ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অসচেতনতা এবং অপরিকল্পিত পরিকল্পনা পরিবেশদূষণের অন্যতম কারণ। বর্তমান প্রেক্ষাপটে পরিবেশ রক্ষা ও সংরক্ষণ করা সবার নৈতিক দায়িত্ব।
প্রতিদিন নানাভাবে পরিবেশকে দূষিত করে চলেছি আমরা। সৃষ্টি করছি জনদুর্ভোগ, সঙ্গে বাড়ছে ডাস্টবিন ব্যবহারে অনীহা। ডাস্টবিন থাকা সত্ত্বেও আবর্জনা যেখানে-সেখানে ফেলা যেন আমাদের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, বাসস্ট্যান্ডে নোংরা পরিবেশ চোখে পড়ার মতো।
নজরদারির অভাবে শহরের রাস্তা বা রাস্তার পাশের ড্রেনগুলোর ভয়ানক অবস্থা। বাসাবাড়ির আঙিনায় ঝোপ-ঝাড়, ময়লাযুক্ত স্থান, ড্রেন পরিষ্কার না করার ফলে মশার উপদ্রব বেড়েই চলেছে। ব্যক্তিগত অবহেলার ফলে পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে প্লাস্টিক সামগ্রী পরিবেশকে দূষণ করে জলজ, স্থলজ, বনজ এমনকি মানবজাতির স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। পলিথিন ব্যাগ, গৃহস্থালির ব্যবহূত প্লাস্টিক, পণ্যের মোড়ক, কসমেটিক্স প্লাস্টিক, পানির জন্য ব্যবহূত প্লাস্টিক বোতলের ব্যাপক ব্যবহার প্রকৃতিকে দূষিত করছে।
প্লাস্টিক এমন একটি রাসায়নিক পদার্থ, যা সহজে পচে না এবং যার পুনঃপ্রক্রিয়াকরণে প্রচুর সময় লাগে। ফলে পরিবেশের ওপর এটি দীর্ঘস্থায়ী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
প্লাস্টিক অপচ্য পদার্থ হওয়ায় বন, জল ও স্থলের সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে এবং প্রাণীর বাসস্থান ও খাদ্য গ্রহণে মারাত্মক বাধার সৃষ্টি করছে। এতে করে প্রাণীর জীবন ধারণ কঠিন হয়ে পড়ছে। কোনো কোনো প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। শুধু প্রাণীর ক্ষেত্রেই নয়, প্লাস্টিক মানবদেহে নানা প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে।
জনসংখ্যা বিস্ফোরণ পরিবেশদূষণের অন্যতম কারণ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে প্রাকৃতিক সম্পদ, জল, বায়ু ও মাটির ওপর প্রচুর চাপ পড়ছে। মানুষ নিজেদের খাবার চাহিদা মেটাতে বনের পর বন উজাড় করে আবাদি জমি তৈরি করছে।
পরিবেশের ভারসাম্য টিকিয়ে রাখতে যে সব প্রয়োজনীয় উপাদান থাকা জরুরি তার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। চাষাবাদ বৃদ্ধির জন্য নানা ধরনের রাসায়নিক সারের ব্যবহার মাটির আর্দ্রতা নষ্ট করে মাটিকে বিষাক্ত করে তুলছে, যা গাছপালাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং মানবদেহে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হচ্ছে।
সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ নিজেদের সুবিধার জন্য তৈরি করছে নানারকম প্রযুক্তি, বাড়ছে ক্রমবর্ধমান হারে শক্তি উত্পাদনের চাহিদা—যা থেকে নির্গত পদার্থ মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ দূষণে অগ্রণি ভূমিকা পালন করে চলেছে।
কলকারখানা ও যানবাহনের ধোঁয়ার কারণে বায়ুদূষণে প্রাণীর বেঁচে থাকা কষ্টকর হয়ে উঠেছে। অধিক নগরায়ন, যানবাহন বৃদ্ধির প্রভাবে পরিবেশ তার বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে।
পরিবেশসংক্রান্ত সমস্যা বর্তমান পৃথিবীর বহুল আলোচিত বিষয়। ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য পৃথিবীতে সুস্থভাবে টিকে থাকতে পরিবেশ সংরক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরি। পরিবেশের অংশ হিসেবে মানুষ পরিবেশ থেকে প্রত্যক্ষ সুফল ভোগ করে। পরিবেশ বিপর্যস্ত হলে অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হবে।
তাই নিজেদের স্বার্থেই মানুষকে পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে। পরিবেশসংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে ব্যক্তিভিত্তিক সমাধানের সঙ্গে সঙ্গে সমন্বিত মনোভাব একান্ত প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো জনসচেতনতা।
পরিবেশকে সুস্থ রাখতে গাছের বিকল্প নেই। অধিক বৃক্ষরোপণ ও বনজ সম্পদকে রক্ষা করে বায়ুদূষণের মাত্রা কমানো সম্ভব। বাস্তুতন্ত্রের যেসব জীব পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে, তাদের টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
পরিবেশ সংরক্ষণসংক্রান্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যে সব নীতিমালা প্রণীত রয়েছে, তার যথাযথ বাস্তবায়ন পরিবেশদূষণের হাত থেকে পরিবেশকে বাঁচাতে পারে। প্রাণের অস্তিত্বের জন্য পরিবেশের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। তাই পরিবেশ সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে সুরক্ষিত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সবুজ, পরিচ্ছন্ন পরিবেশবান্ধব বাসযোগ্য বাংলাদেশ গড়তে আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে এগিয়ে আসতে হবে। ব্যক্তিগত সতর্কতা এই সমস্যার সমাধানে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
নিজের বাড়ি বা প্রতিষ্ঠানের ডোবানালা বা ঝোপ-জঙ্গল নিজ দায়িত্বে পরিষ্কার করতে হবে। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা আমাদের পরিবেশকে বাঁচাতে পারি।