খুব সাধারণ ভাষায় বোঝাতে হলে এই পৃথিবীতে অনেক রকম প্রাণীর বাস, একেই জীববৈচিত্র্য বলে। আর বিজ্ঞানের ভাষায় বলতে গেলে জীববৈচিত্র্য (Biodiversity) হল উদ্ভিদ, প্রাণী ও অণুজীবসহ পৃথিবীর গোটা জীবসম্ভার, তাদের অন্তর্গত জীন ও সেগুলির সমন্বয়ে গঠিত বাস্তুতন্ত্র।
এবারে আসি জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব প্রসঙ্গে। মানুষ তথ্য সমগ্র জীবজগতের কাছে জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব অপরিসীম। একটু বিস্তারিত বিবরণ দিলে বোঝা যাবে..
(১) বাস্তুতান্ত্রিক মূল্য : বাস্তুতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে জীববৈচিত্র্য বিশেষ ভূমিকা পালন করে। একই বাস্তুতন্ত্রের বিভিন্ন জনগোষ্ঠী পরস্পর নির্ভরশীল হয়ে বসবাস করে। তাই প্রজাতির বৈচিত্র্য যত বাড়বে বা প্রজাতির সংখ্যা যত বাড়বে, সেই বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য তথা স্থিতিশীলতা তত বাড়বে।
বাস্তুতন্ত্রের যেকোনো একটি উদ্ভিদ বা প্রাণী প্রজাতির বিলুপ্ত হওয়ার অর্থ, সংশ্লিষ্ট উদ্ভিদ বা প্রাণী প্রজাতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত খাদ্য শৃঙ্খলে বিঘ্ন ঘটা। তাই বাস্তুতন্ত্রের সার্বিক ভারসাম্য রক্ষায় জীববৈচিত্রের গুরুত্ব অনবদ্য।
(২) অর্থনৈতিক মূল্য : মানুষ তার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, ওষুধপত্র প্রভৃতির জন্য সরাসরি প্রকৃতির ওপর নির্ভর শীল। জীববৈচিত্র্যের জন্যই মানুষ তার ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদা প্রকৃতি থেকে মেটাতে সক্ষম হয়।
মানুষ বৈচিত্রময় উদ্ভিদ প্রজাতি থেকে কেবল খাদ্যসামগ্রী পায় তাই নয়; ওষুধ, কাঠ, কাগজ, তন্তু, রবার, আঠা, রজন, ট্যানিন, ফুলফল ইত্যাদিও পায়। তেমনই বৈচিত্রময় প্রাণী প্রজাতি থেকে মাছ মাংস, দুগ্ধ সামগ্রী, চামড়া, পালক, উল, লাক্ষা, মধু ইত্যাদি সংগ্রহ করে। আবার, বিভিন্ন জীবাণুর নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের মাধ্যমেও বিভিন্ন শিল্পসমগ্রী উৎপাদন করা যায়। এককথায় খাদ্য ও স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য মানুষ জীববৈচিত্রের ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল।
(৩) পরিবেশ রক্ষায় জীববৈচিত্র্য : পরিবেশ দূষণ রোধ করতে জীবমন্ডলের (biosphere) সার্বিক সংরক্ষণ ও কার্যকারিতা বজায় রাখার কারণে জীববৈচিত্র্য আবশ্যক। পরিবেশে অক্সিজেনের সরবরাহ বজায় রাখতে, বৃষ্টিপাত ঘটাতে উদ্ভিদের ভূমিকা অপরিহার্য। [বর্তমানে সবুজ উদ্ভিদের ধ্বংস হওয়া বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রধান কারণ]
(৪) জিন ভান্ডার হিসেবে জীববৈচিত্র্য : জীববৈচিত্র্য হল প্রকৃতপক্ষে বিপুল সংখ্যক জিনের ভান্ডার (gene pool)। বিভিন্ন জীবের এই জিন ভান্ডার মানুষের কাছে এক অমূল্য সম্পদ। এই জিন ভান্ডারে অসংখ্য উত্তম গুণসম্পন্ন জিন রয়েছে, জৈবপ্রযুক্তি র মাধ্যমে যা সংগ্রহ করে অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্পন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণী তে স্থানান্তরিত করে পছন্দসই গুণসম্পন্ন উচ্চ ফলনশীল ট্রান্সজেনিক উদ্ভিদ ও প্রাণী তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। এর দ্বারা মানব জাতির ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে।
(৫) নান্দনিক ও শিক্ষাগত মূল্য : যেকোনো দেশের জীববৈচিত্র্য সেই দেশের সম্পদ। বিভিন্ন প্রজাতির জীব, প্রকৃতিকে বৈচিত্র্যময় ও সুন্দর করে তোলে। এই সম্পদের নমুনা চিড়িয়াখানা, মিউজিয়াম, বোটানিক্যাল গার্ডেনে সংরক্ষণের মাধ্যমে তাদের সাথে সাধারণ মানুষের পরিচয় ঘটানো হয়। ফলে নান্দনিক সৌন্দর্য ও শিক্ষাগত মূল্য বৃদ্ধি পায়।
(৬) নৈতিক মূল্য : প্রত্যেক জীবের এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার পূর্ণ অধিকার আছে। ১৯৮২ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ র বিশ্বপ্রকৃতির ঘোষণাপত্রে এই চিন্তাধারা স্বীকৃতি পেয়েছে। তাই আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য প্রতিটি প্রজাতির জীব কে বাঁচিয়ে রাখা। এর জন্য দরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ ও গুরুত্ব সম্বন্ধে মানুষজনকে সচেতন করা।