জীবজগত ও পরিবেশের ওপর মাইক্রোপ্লাস্টিকের বিরূপ প্রভাব
সহজলভ্যতা, বহুমুখী ব্যবহার, স্বল্পমূল্য, হালকা ওজন ও উচ্চস্থায়ীত্বের ফলে নানা ধরনের প্লাস্টিক সামগ্রী—যেমন প্লাস্টিক ব্যাগ, ফিল্ম, সিন্থেটিক পোশাক, কার্পেট, থালাবাসন, ঘটি-বাটি, বোতল, টায়ার, খেলনা, প্যাকেটজাত দ্রব্য, সার, যন্ত্রপাতি, যানবাহনের বডি ও যন্ত্রাংশ ইত্যাদি—পরিণত হয়েছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক অনিবার্য উপাদানে।
নিত্যব্যবহার্য এসব প্লাস্টিক সামগ্রী, সিন্থেটিক টেক্সটাইল ও কলকারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে পড়ছে পরিবেশে।
পরে তাপমাত্রা, অণুজীব এবং পরিবেশে বিভিন্ন ক্রিয়া-বিক্রিয়ার কারণে এ সব প্লাস্টিক ভেঙে পরিণত হয় বিভিন্ন আকারের প্লাস্টিকে, যা আবারও পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান ও সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে ক্ষয় হয়ে পরিণত হয় ছোট ছোট প্লাস্টিক কণা, পাউডার কণা বা অতি ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণায়। বিজ্ঞানের ভাষায় এসব অতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণাকে বলা হয় মাইক্রোপ্লাস্টিক বা মাইক্রোপ্লাস্টিক ফাইবার।
প্লাস্টিক মূলত চার ধরনের—অতি ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা (ন্যানোপ্লাস্টিক, ১-১০০০ ন্যানোমিটার), ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা (মাইক্রোপ্লাস্টিক, ১-১০০০ মাইক্রোমিটার), মাঝারি আকারের প্লাস্টিক কণা (মেসোপ্লাস্টিক, ১-১০ মিলিমিটার) এবং বড় প্লাস্টিক কণা (ম্যাক্রোপ্লাস্টিক, ১ সেন্টিমিটারের বেশি)।
এ সব প্লাস্টিক কণা মাটিতে বা পরিবেশে টিকে থাকতে পারে ৪০০ বছরেরও বেশি। আর এরই ফলাফল বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে প্লাস্টিক দূষণ। বাতাস, মাটি ও পানির ওপর প্লাস্টিকের দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব পরিবেশকে ঠেলে দিচ্ছে হুমকির মুখে, জনস্বাস্থ্যের ওপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব।
এ ছাড়াও প্লাস্টিক ও পলিথিন পোড়ানোর ফলে প্রতিনিয়ত ঘটছে বায়ু ও মাটি দূষণ। প্লাস্টিক কণাকে তাই এখন ক্ষতিকর দূষক হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
প্রাথমিকভাবে মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রধান উৎস সাতটি। সিন্থেটিক টেক্সটাইল, টায়ার, সামুদ্রিক/মেরিন কোটিং, রোড মার্কিং, প্রাইভেট কেয়ারিং পণ্য, প্লাস্টিক বড়ি (পিলেট) এবং সিটি ডাস্ট (টায়ার, গৃহস্থালি প্লাস্টিক বর্জ্য, টেক্সটাইল বর্জ্য ইত্যাদি)৷ এর ভেতর টেক্সটাইল, টায়ার এবং সিটি ডাস্ট—এই তিনটি উৎসই শতকরা ৮০ ভাগ দূষণের জন্য দায়ী৷ সমুদ্রিক দূষণের শতকরা ৩৫ ভাগ মাইক্রোপ্লাস্টিক আসে টেক্সটাইল ও পোশাক থেকে৷
এ সবই মূলত পলিয়েস্টার, নাইলন ও অ্যাক্রিলিক ফাইবারের (অনেকে অ্যাক্রাইলিকও বলেন) তৈরি পোশাক, হোম টেক্সটাইল, প্রযুক্তিগত টেক্সটাইল, মেডিকেল টেক্সটাইল ইত্যাদি৷
সাধারণত শিল্পকারখানায় লং-চেইন সিন্থেটিক পলিমার (যেসব পলিমার অণুতে বিপুল সংখ্যক পরমাণু থাকে)—পলিয়েস্টার, অ্যাক্রিলিক, লাইক্রা, স্প্যানডেকস, নাইলন ইত্যাদির তৈরি পোশাক ধোয়া এবং রং করার সময় পানিতে প্রচুর পরিমাণ মাইক্রোফাইবার বিমুক্ত হয়।
পরে এই মাইক্রোফাইবার ছড়িয়ে যায় পানির সর্বস্তরে৷ আর পলিয়েস্টার বা সিন্থেটিক ফাইবারের পোশাক তৈরি ও ব্যবহারের সময় ঘর্ষণে ভেঙে বাতাস ও ধোয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে পরিবেশে৷
এ ছাড়াও বর্তমানে ওষুধ শিল্প, সাবান ও ডিটারজেন্ট, টুথপেস্ট, ক্রিম, লোশন ইত্যাদি বিভিন্ন প্রসাধনীর মতো দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত নানা পণ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিক ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে পরিবেশ দূষণের কারণ।
বিশ্বের প্লাস্টিক রপ্তানিকারক দেশের তালিকায় বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৯তম৷ রপ্তানিকৃত প্লাস্টিকের প্রায় ৮০% কাঁচামাল ব্যবহৃত হয় পোশাক কারখানায় এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি জার্নালের নভেম্বর ২০১১ সংখ্যায় প্রকাশিত অ্যালগালিটা (Algalita, ২০১২) নিবন্ধ অনুসারে, একটি পলিয়েস্টার পোষাক প্রতিবার ওয়াশিংয়ে বিমুক্ত ফাইবারের সংখ্যা ১৯০০-এরও বেশি।
পরীক্ষার ফলাফল থেকে আরও দেখা যায়, প্রতি লিটার বর্জ্য পানিতে নিষ্কৃত মাইক্রোফাইবারের সংখ্যা ১০০-এর ওপরে৷ গবেষকদের মতে, পলিয়েস্টার কাপড় ধোয়া পানি সামুদ্রিক প্লাস্টিক দূষণের অন্যতম কারণ হতে পারে৷ এ গবেষণা-কাজে সারা বিশ্বের মোট ১৮টি উপকূল থেকে নমুনা সংগ্রহ করে প্রতিটিতেই মাইক্রোফাইবারের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এর প্রায় পুরোটাই পলিয়েস্টার।
বাংলাদেশ প্রতিবছর প্লাস্টিকের কাঁচামাল আমদানি ও প্লাস্টিক ফ্লেক্স রপ্তানি করে৷ বিশ্বের প্লাস্টিক রপ্তানিকারক দেশের তালিকায় বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৯তম৷ রপ্তানিকৃত প্লাস্টিকের প্রায় ৮০% কাঁচামাল ব্যবহৃত হয় পোশাক কারখানায়৷
পোশাকখাতে প্লাস্টিক দূষণে মূল ভূমিকা রাখছে প্লাস্টিকের তৈরি বোতাম, হ্যাঙ্গার, প্যাকেট, কলার ক্লিপ, ইলাস্টিক ইত্যাদি৷ এ ছাড়াও বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম পলিয়েস্টার স্টেপল ফাইবার (পোশাক, হোম ফার্নিশিং, প্রযুক্তিগত টেক্সটাইল ইত্যাদি) এবং পলিয়েস্টার-মিশ্রিত কাপড় রপ্তানিকারক দেশ।
২০২২ সালে দেশের ২ হাজার ৯২৫টি আমদানিকারক সংস্থাকর্তৃক আমদানিকৃত পলিয়েস্টার কাপড়ের পরিমাণ প্রায় ৮৫.১ হাজার টন (Volza’s Bangladesh Export Data, ২০২২), যা পোশাকখাতে পলিয়েষ্টার পোশাকের চাহিদা পূরণে মুখ্য ভূমিকা রাখে৷
খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে প্লাস্টিক সংশ্লেষিত হয়। এ ধরনের প্লাস্টিক একধরনের দীর্ঘ পলিমার চেইন, যা সহজে পঁচনশীল নয়।
শীতল তাপমাত্রার কারণে সমুদ্রের তলদেশে এর পঁচন ঘটে আরও ধীর গতিতে৷ আর সিনথেটিক মাইক্রোফাইবার বায়োডিগ্রেডেবল না হওয়ায় পরিবেশে টিকে থাকে দীর্ঘ সময়৷ এ ছাড়া মাইক্রোফাইবার দূষণের প্রভাব পড়ছে বাতাস, ভূপৃষ্ঠ, এমনকি সমুদ্রের ওপরও৷ আবার মাছ, জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ পরিবেশে টিকে থাকা অপঁচনশীল মাইক্রোপ্লাস্টিক খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে, যা পরবর্তীতে শ্বাস-প্রশ্বাস ও খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে প্রবেশ করে মানবদেহে৷