জলবায়ু পরিবর্তন: গর্ভেই শিশুমৃত্যু সঠিক কারণ কেউই জানেন না
গবেষকরা বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিভিন্ন ঝুঁকির মধ্যে একটি নতুন ঝুঁকি দেখতে পেয়েছেন ৷ মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে নারীদের গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও মাটির উর্বরতা কমে যাচ্ছে ক্রমশই। অবস্থা সম্পন্নরা গ্রাম ছাড়ছেন কিস্তু চরম ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন যারা নিরুপায় ভাবে বসবাস করছেন ৷
চট্টগ্রামের চকরিয়া উপজেলার ফাইলাপাড়া গ্রামের নারীদের গর্ভের সন্তান নষ্ট হবার পরিমান বেড়েছে এবং তারা তাদের গর্ভের সন্তান নষ্ট হবার বিষয়টি স্বীকার করলেও কেউই জানেন না কেন এমন হচ্ছে৷ মাটি ও পানিতে অতিরিক্ত লবণের উপস্থিতি এবং তার প্রভাবের বিষয়টি জানার পর অনেকেই অবাক হয়ে যান।
৩২ বছর বয়সী সেনোয়ারা বেগমের আড়াই মাস বয়সী গর্ভের শিশু নষ্ট হয় এক বছর আগে৷ সাত মাস হলো তিনি পুনরায় গর্ভধারণ করেছেন৷ এখন পর্যন্ত গর্ভের বাচ্চা সুস্থ থাকলেও অজানা আশঙ্কা কাজ করছে বলে তিনি প্রতিবেদককে জানান৷
চট্টগ্রামের চকরিয়া উপজেলার ফাইলাপাড়া গ্রামের সকল স্বাস্থ্যকর্মী এবং অধিকাংশ ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় অধিকাংশ নারীরই গর্ভের বাচ্চা ভ্রূণের বয়স ৬ মাস পূর্ন হবার আগেই মারা যায় । যদিওএ বিষয়ে কেউ কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে পারলেন না।
সাতবার মারা যাওয়ার পর অষ্টমবারে দুই কন্যা সন্তানের মা রাজিয়া আক্ষেপ করে বলেন,এতবার গর্ভের বাচ্চা নষ্ট হওয়ার যে কি কষ্ট এবং বারবার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা ছাড়া কিছুই না। ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ইসমত জাহান খুকি এবং কাওসার জান্নাত আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর’বি) এর চকরিয়া শাখায় মাঠকর্মী হিসেবে কাজ করেন৷
তারা জানান, গর্ভের বাচ্চা নষ্ট হওয়ার ব্যাপারে গ্রামের নারীদের তারা দু’জন প্রতিনিয়ত সচেতন করে আসছেন৷ তবে জানার পরও এই এলাকায় যাদের বসত ভিটা এবং এটি ছেড়ে অন্য কোথাও আশ্রয় নেওয়ার মতো বিত্তবান তারা নন৷ যত সমস্যাই থাকুক, এখানেই তাদের থাকতে হবে৷
ফাইলাপাড়া, মানিকপাড়াসহ চকরিয়া উপজেলার অন্যান্য গ্রামগুলোর বিভিন্ন শুকনো জায়গাতেও সাদা প্রলেপ দেখতে পাওয়া যায়৷ এ সম্পর্কে জানতে চাইলে একজন গ্রামবাসী বলেন, এগুলো লবণের ভাব৷ কোথাও পানি উঠলে তা নেমে যাওয়ার পর এরকম সাদা হয়ে থাকে৷
বছর বয়সী উম্মে হাবিবার (৪০) গর্ভের বাচ্চা নষ্ট হয় ২ বছর আগে৷ এখানকার মাটি এবং পানিতে অতিরিক্ত লবণের বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, ২৫-৩০ বছর আগেও এখানকার জমিগুলো অনেক উর্বর ছিল অনেক ফসল ফলতো৷ কিন্তু এখন আর তেমন কোন ফসল না ফলায় অনেকেই কৃষিকাজ ছেড়ে দিয়েছেন৷ সামগ্রিক বিষয়ে তিনি সরকারের সুদৃষ্টি আশা করেন৷
চকরিয়ার মানিকপাড়া গ্রামের সানোয়ারা বেগমের দুইটি সন্তানের মধ্যে শেষ সন্তানটি গর্ভে মারা যায় ১১ বছর আগে৷ তিনি বলেন, “অনেকেরই তো শুনি বাচ্চা পেটে মারা যাইতেসে, কিন্তু এর পিছে যে এই কারণ সেটা তো আন্দাজ করতে পারি নাই৷ আমরা ভাবসি, আল্লাহ্র হুকুম হইসে, বাচ্চা পেটেই মারা যাইতেসে৷’’
মানিকপাড়া গ্রামের রোমানা বেগমের প্রথম সন্তানটিই গর্ভে থাকাকালীন মারা যায় তিন বছর আগে৷ আল্ট্রসনোগ্রাম করার মাধ্যমে তিনি বিষয়টি চিকিৎসকের কাছে জানতে পারেন৷ প্রথম সন্তানটি গর্ভে মারা যাওয়ায় শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কাছে কটু কথা শুনতে হয় ৷
চকরিয়ার নিকটবর্তী একাধিক গ্রামে ঘুরে দেখা যায়, এখানকার পুরুষদের অধিকাংশই লবণের ব্যবসার সাথে জড়িত৷ শুকনো মৌসুমে তারা লবণ সংগ্রহ ও বিক্রি করে রাখেন৷ প্রতি মণ অপরিশোধিত লবণ বিক্রি হয় ৫০০-৬০০ টাকার মধ্যে৷ আর যারা লবণের ব্যবসা করেন না, তাঁরা শহরে বা উপশহরে গিয়ে অন্য কিছু করেন৷
আইসিডিডিআর’বি এর বিজ্ঞানী ড. মানজুর হানিফি এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত৷ তিনি বলেন, সাধারণত একজন সুস্থ মানুষ দিনে ৫ গ্রাম লবণ খেলেও এখানকার মানুষেরা খায় ১৬ গ্রাম৷ সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা থেকে যারা ২০ কিলোমিটার দূরে থাকেন, তাদের চেয়ে এখানে গর্ভের বাচ্চা মারা যাওয়ার হার দেড় গুণ বেশি যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে৷ দেশের দক্ষিণাঞ্চল তথা খুলনা, সুন্দরবনেও এর ব্যতিক্রম হবার সম্ভাবনা নেই৷