জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে ঐতিহ্য স্থাপনা
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে বৃষ্টি, বন্যা, তাপমাত্রা ও জলোচ্ছ্বাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি সূচক বিষয়ক আলোচিত গবেষণাপ্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচ তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত জলবায়ুর বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বের ১০টি শীর্ষ ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশ জিডিপির ১.৮ শতাংশ হারাচ্ছে এবং জলবায়ুসৃষ্ট নেতিবাচক প্রভাবগুলো অব্যাহত থাকলে এর পরিমাণ ২০৩০ সালের মধ্যে ২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের নীতি ও পরিচালনার পরিকল্পনায় প্রকৃতি, মানুষ ও অবকাঠামো বিশেষ গুরুত্ব পেলেও ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর সংরক্ষণের বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের ঐতিহ্য স্থান ও স্থাপনাগুলো বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের হিসাব মতে, বাংলাদেশের ৫২২টি সংরক্ষিত পুরাকীর্তির মধ্যে ১২৮টি স্থাপনা রয়েছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় (খুলনা ও বরিশাল বিভাগে) এবং এর মধ্যে ৫৯টি ঐতিহ্য স্থাপনা উন্মুক্ত উপকূলীয় এলাকায় রয়েছে, যা সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির মুখে রয়েছে।
জাতিসংঘের আন্ত সরকার জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত প্যানেলসহ (আইপিসিসি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, উপকূলীয় অঞ্চলগুলো একবিংশ শতকজুড়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাবে, নিচু এলাকায় আরো ঘন ঘন বন্যা হবে এবং উপকূল ক্ষয়প্রাপ্ত হবে।
Climate Change Cell (CCC) গত ৩০ বছরের (১৯৮০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে) জোয়ারের পানির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতিবছর ৬-২১ মিলিমিটার হয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে ২০৩০, ২০৫০ ও ২১০০ সালের মধ্যে যথাক্রমে ১৪ সেন্টিমিটার, ৩২ সেন্টিমিটার ও ৮৮ সেন্টিমিটার সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেতে পারে।
এরই মধ্যে বাংলাদেশে গ্রীষ্মকাল প্রলম্বিত হয়েছে এবং বৃষ্টিপাতের ধরনও পরিবর্তন হয়ে গেছে। এই দুটির পরিবর্তনে দেশে বন্যা ও খরার ঝুঁকি বাড়তে পারে। মৌসুমি বৃষ্টিপাতের ধরন পরিবর্তনের ফলে বছরজুড়ে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলবর্তী জেলাগুলোতে আরো বেশি বৃষ্টিপাতের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়েছে।
ঐতিহ্য স্থাপনাগুলো যেকোনো একটি জাতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে এগুলো পূর্ববর্তী সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সহায়তা করে এবং একবার ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে তা আর কোনোভাবেই পূর্বাবস্থায় ফেরত আনা সম্ভব নয়।
এই স্থাপনাগুলো ভঙ্গুর বলে যথাযথ সংরক্ষণ না করলে তা বিনষ্ট হবে এবং কালের গর্ভে চিরকালের জন্য হারিয়ে যাবে। এই কারণে United Nations Office for Disaster Risk Reduction কর্তৃক প্রস্তুত করা Sendai Framework-এ ঐতিহ্য স্থাপনাগুলোর সংরক্ষণের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
২০১৯ সালে স্থাপত্য বিভাগ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের ঐতিহ্য স্থাপনাগুলোর ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবসংক্রান্ত এক সেমিনার ও কর্মশালায় যে বিষয়গুলো আসে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে—স্থাপনাগুলোর জন্য স্থানীয় জলবায়ু ও পরিবেশের বিষয়ে চিন্তা করে যথাযথ সুরক্ষা পরিকল্পনা প্রয়োজন এবং এর জন্য নতুন ও উদ্ভাবনী গবেষণার প্রয়োজন।
বাংলাদেশের সব ঐতিহ্যবাহী স্থান ও স্থাপনাগুলোর সংরক্ষণের কাজ বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে মিলিতভাবে সম্পন্ন করছে। তবে স্থাপনাগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব বিষয়ক প্রাসঙ্গিক জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও অবকাঠামো সুবিধার অভাবের কারণে ওই প্রতিষ্ঠানটি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না।
এই অমূল্য স্থাপনাগুলোর ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব বিবেচনা করে এগুলোর ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অনুধাবন, ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ ও যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি প্রয়োজন। সর্বোপরি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রস্তুত করা জলবায়ু নীতিমালায় ঐতিহ্য স্থাপনাগুলোর সংরক্ষণের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে স্থান দেওয়া প্রয়োজন।