জলবায়ু পরিবর্তন তার সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছেছে
পৃথিবীতে যে ঘটনাগুলো মানব মনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আলোচনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তার মধ্যে একটি হলো জলবায়ু পরিবর্তন। যা কেঁড়ে নেয় মানুষের শেষ সম্বলটুকুও, এনে দেয় হাজারো আহাজির মিশ্রিত ঘটনা। সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরিবর্তন যেন তার চূড়ায় পৌঁছেছে।
গ্রীষ্মের সময়ে অতিরিক্ত গরমের কারণে বসবাস করা যেমন দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে তেমনি শীতকালে অতিরিক্ত শীত, বর্ষার মৌসুমে অতিরিক্ত বর্ষা ও সময়ে-অসময়ে প্রকৃতির বৈরী রূপ জানান দিচ্ছে তা কতটা সময়ান্তরে পরিবর্তনের স্বাদ পেয়েছে।
দুনিয়াজুড়ে এ যেন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটা চলছে। পৃথিবীর কোনো না কোনো প্রান্তেই ঝড়, খরা, বন্যা, দাবানল কিংবা কোথাও শৈত্যপ্রবাহ লেগেই রয়েছে।
প্রকৃতি দুর্যোগের এত রমরমা বিরূপ আয়োজনের মধ্যে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ঘূর্ণিঝড় রেমাল। ঘূর্ণিঝড় রেমালের ভয়াবহতা সময়ের দিক দিয়ে এ যাবতকালে ঘূর্ণিঝড় আইলাকেও হার মানাচ্ছে।
ঘূর্ণিঝড় আইলা ৩৪ ঘণ্টা ধরে ভূখন্ডে প্রভাব বিস্তার করলেও, সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় রেমাল সময়ের হিসাবে প্রায় ৪৫ ঘণ্টা অবস্থান করছে- যা ঘণ্টায় ৯০ কিলোমিটার থেকে ১২০ কিলোমিটার গতিবেগ নিয়ে উপকূলে বসবাসরত প্রান্তিক মানুষ থেকে শুরু করে শহরের জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এতে যেমন জন্ম দিয়েছে হতাহতের সংখ্যা, তেমনি তৈরি করছে মানুষের মনে নানা ভাবাবেগ।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর রক্ষা কবচ ওজোন স্তর। এতে ভবিষ্যতের সময়গুলোতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহ মাত্রা আরো বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে পৃথিবীতে বসবাস করা যেমন দুঃসাধ্য হবে তেমনি এই গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব নিয়ে হুমকির মুখে পড়তে হবে। যদি প্রশ্ন করা হয় জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মূল দায়ী কে? তাহলে উত্তর বোধ হয় মানুষই আসবে।
মানুষ তার প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে প্রতিনিয়তই পরিবেশ ধ্বংস করছে, জীবাশ্ম জালানি উত্তোলন করছে, অপরিকল্পিত বাসাবাড়ি গড়ছে, মাত্রাতিরিক্ত কলকারখানা থেকে দূষিত ধোঁয়া পরিবেশে কার্বন ডাই- অক্সাইডের পরিমাণ বাড়াচ্ছে ও আরাম আয়েশের ব্যবস্থার জন্য মানুষ প্রাকৃতির উপাদানকে মূল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে- যা শুধু পরিবেশের স্বাভাবিক অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে না বরং প্রকৃতি তার জবাব দুর্যোগের মাধ্যমে মানুষকে দিচ্ছে।
অতীতে মানুষ প্রকৃতির অধীনে থাকলেও বর্তমানে প্রকৃতিকে মানুষের অধীনে থাকতে হচ্ছে। ফলে মাত্রাতিরিক্ত তেল, গ্যাস, কয়লা উত্তোলনের কারণে অতীতের তুলনায় পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েছে ১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই- অক্সাইডের পরিমাণ উনবিংশ শতকের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে।
মানুষের শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও মিথেনসহ নানা গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হয়ে প্রতিনিয়ত বাতাসে মিশছে। বায়ুমন্ডলে এসব গ্যাস, কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের বার্ষিক গড় দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৪১০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন), ১৮৬৬ পিপিবি (পার্টস পার বিলিয়ন) ও ৩৩২ পিপিবি। যা পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ানোর জন্য প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন সময়ে-অসময়ে সৃষ্টি হচ্ছে তেমনি তা থেকে জলাবদ্ধতা, পানিদূষণ, নিরাপদ খাবার পানির অভাব ও খাদ্যাভাব দেখা দিচ্ছে।
বন্যার কয়েকদিনের মধ্যেই ডায়রিয়া ও অন্যান্য পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব করছে। জলোচ্ছ্বাসের ফলে পানিতে ডুবে মৃতু্য, সাপের কামড় মতো ঘটনা ঘটছে তেমনি পানি শুকিয়ে এলে খোসপাঁচড়াসহ বিভিন্ন চর্মরোগের সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিশ্ব নেতারা নানা সম্মেলনে তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার কথা বলে থাকলেও, মূলত তাদের স্বেচ্ছাচারিতার অভাবের কারণে তাপমাত্রার বৃদ্ধি রোধ করা যাচ্ছে না।
তাপমাত্রা বৃদ্ধি রোধে তাদের সত্যিকার পদক্ষেপ বাস্তবায়ন না ঘটলে, নিঃসন্দেহে ভবিষ্যতে আরো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হবে।
মানুষের অপকর্মের জের টানছে প্রকৃতি। যার মাশুল গুনতে গিয়ে জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুসংস্থান হুমকির মুখে পড়ছে। ফল হিসেবে গলে যাচ্ছে মেরু অঞ্চল ও সুউচ্চ পর্বতমালায় জমে থাকা হিমবাহ ও বরফের স্তর।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য আমাদের সবাইকে যার যার জায়গা থেকে এগিয়ে আসতে হবে, গাছ লাগাতে হবে ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নিরাপদের কথা ভেবে হলেও অপকর্মের ইতি টানতে হবে। এর জন্য বিশ্ব নেতাদের মুখ্য ভূমিকার বিকল্প নেই। তাদের কর্মই ভবিষ্যৎ পৃথিবীর বার্তা দেবে।