জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে হবে
১৭৪৫ সালে লিফি নদীর তীরের ভাঙনে যখন আইরিশ অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক এডমন্ড বার্কের বাড়ির ভিত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তখন তিনি বাড়িতেই ছিলেন এবং ঘটনাটি নিজে চোখে প্রত্যক্ষ করেন।
এটি ছিল তার জন্য এক অদ্ভুত রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। যে মানুষটি আধুনিক রক্ষণশীলতার ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করতে চলেছিলেন, তিনি এই ঘটনায় এতটাই অনুপ্রাণিতই হয়েছিলেন, তার পরবর্তী লেখনিতে তিনি এই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন।
তার মতে, ভয়াবহ ধ্বংসের সেই অতুলনীয় দৃশ্য একটি রোমাঞ্চকর আলোচনার সৃষ্টি করতে পারে, তা যদি নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে পর্যবেক্ষণ করা হয়।
বিগত সপ্তাহগুলোয় এই ধ্বংসের দৃশ্যগুলোর ব্যাপারে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যে জিনিস উপলব্ধি হয়েছে, তা হলো এটা পর্যবেক্ষণের জন্যও পৃথিবীতে নিরাপদ কোনো স্থান নেই।
জার্মান শহর এরফ্ট্যাডটের মাটির নিচু জমিটি বন্যার পানিতে টিস্যু পেপারের মতো ছিঁড়ে গেছে, উচ্চতর তাপমাত্রার রেকর্ড গড়ার ঠিক একদিন পরেই মানচিত্র থেকে পুড়ে যায় ব্রিটিশ কলম্বিয়ার লাইটন, চীনের ঝেংঝু শহরের রাস্তাগুলো বন্যার পর খালে পরিণত হয়ে পড়ে, সেখানে গাড়িগুলোকে মরা মাছের মতো ভাসতে দেখা যায়। মোট কথা, পৃথিবী এখন এক বিরাট ঝুঁকির মধ্যে আছে।
গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন, বার্কের প্রাক-শিল্পকালের তুলনায় ১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড (১.৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট) এর চেয়েও বেশি উষ্ণ এক গ্রহের জন্ম দিয়েছে।
পূর্বের জমে থাকা এবং বায়ুমণ্ডলে নতুনভাবে সৃষ্ট নির্গমন, পূর্বাভাস অনুযায়ী এবং একইসঙ্গে আকস্মিকভাবেও আবহাওয়াকে প্রতিনিয়ত ভারি করে তুলছে। এই পরিমাণ নিঃসরণ অব্যাহত থাকলে, নিঃসন্দেহে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে।
দুর্ভাগ্যক্রমে, ২০২১ সালই সম্ভবত একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে শীলততম বছরগুলোর মধ্যে একটি হবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় গৃহীত সিদ্ধান্ত ও প্রতিজ্ঞাগুলো যদি যথাযথভাবে পালন করাও হয়, তবু আগামী দশকগুলোতে তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প স্তরের তুলনায় ৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত বাড়তে পারে।
আর এমনটি হলে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের বড় অংশের জন্য বাইরের কাজ করা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে শুধুমাত্র উত্তাপের কারণে। প্রবাল প্রাচীর, আমাজন রেইনফরেস্ট-সহ যেসব উপাদানের ওপর তাদের জীবিকা নির্ভরশীল, সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে। মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ফসলের জমি।
অ্যান্টার্কটিকা ও গ্রিনল্যান্ডের বরফ গলতে শুরু করবে, যা কোনোভাবেই ঠেকানো যাবে না। সমুদ্রের উচ্চতা বিশ্ব শক্তিদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এখনকার মতো মিলিমিটারে নয়, বরং মিটারে বৃদ্ধি পেতে শুরু করবে।
ছয় বছর আগে, ফ্রান্সের প্যারিসে রাষ্ট্রগুলো পৃথিবীর তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে ধরে রাখার জন্য সহসাই গ্রিনহাউস-গ্যাস নির্গমন কমানোর ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা এড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতির তেমন অগ্রগতি দেখা যায়নি।
তবু যদি তাদের প্রচেষ্টায় তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের লক্ষ্য পূরণে সমর্থ হয়, তারপরও বিশ্বের অরণ্যগুলোকে পুড়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে পারবে না; বৃক্ষহীন তৃণভূমিগুলো ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাবে, নদীর পাড়গুলো ভেঙে পড়বে এবং পর্বতসমূহের হিমবাহগুলো অদৃশ্য হয়ে যাবে।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় শুধুমাত্র গ্রিনহাউস গ্যাসের উদগীরণ কমানোই যথেষ্ট ও একমাত্র পন্থা নয়। পুরো পৃথিবীকেই জরুরি ভিত্তিতে পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে বিনিয়োগ করতে হবে।
এখানে আশার কথা হলো, ‘অভিযোজন’ প্রক্রিয়াটি রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য। সবাই এর প্রয়োজনীয়তা স্পষ্টরূপে উপলব্ধি করতে পারবে। যখন কোনো দেশ বন্যার প্রতিরক্ষায় বিনিয়োগ করে, তখন সেটা তার নিজের নাগরিককে সুরক্ষা দেয়। জগতে বিনা খরচায় কোনো সমস্যার সমাধান নেই, যেমনটা নির্গমন হ্রাসের পদক্ষেপের ক্ষেত্রেও সত্য।
কিছু অভিযোজন প্রক্রিয়া মোটামুটি সহজভাবেই যেকোনো জায়গায় পরিচালনা করা যায়। আসন্ন বন্যার বিষয়ে জার্মানদের সতর্ক করার প্রক্রিয়া এখন অবশ্যই উন্নত হয়েছে।
তবে অন্য সমস্যাগুলোর জন্য বড় ধরনের সরকারি বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়, যেমনটা নেদারল্যান্ডসের পানি পরিচালনা প্রক্রিয়ার জন্য চালু করা হয়েছে। অবশ্য ধনী দেশগুলো এ জাতীয় ব্যয় সহজে বহন করতে পারলেও দরিদ্র দেশগুলোর জন্য সাহায্য প্রয়োজন।
এ কারণেই প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে ধনী দেশগুলো হতে দরিদ্র দেশগুলোয় বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার স্থানান্তর করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
তবে উন্নত দেশগুলো এখনো এদিকে অতটা মনোযোগ দিচ্ছে না। গত ২০ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক বিশেষ দূত জন কেরি ২০২৪ সালের মধ্যে দরিদ্র দেশগুলোতে অভিযোজন করার জন্য আমেরিকার প্রতিশ্রুত অনুদান তিন গুণ করে ১.৫ বিলিয়ন ডলার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অভিযোজন ও প্রশমনের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা হবে। সমস্যা সমাধানে এ জাতীয় প্রচেষ্টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তবে তাদেরও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অল্প থাকতে হয়তো মোকাবেলাটা সহজ, কিন্তু সমস্যা প্রকট হলে সেটার সমাধান হয়ে পড়ে কঠিন।
যদি প্যারিসের লক্ষ্যমাত্রা আনুযায়ী ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা যায়, তারপরও এই সীমাবদ্ধতাগুলোর সম্পূর্ণ পরিধি পরীক্ষা করা সম্ভব না।
নির্গমন কমানোর উদ্যোগটিও হয়তো প্রয়োজন অনুসারে ত্বরান্বিত করা হবে না। এছাড়া জলবায়ু এখন যে পরিস্থিতিতে রয়েছে, হয়তো ভবিষ্যতে এরচেয়েও সংবেদনশীল হয়ে উঠতে পারে, অনেক গবেষক এটাই বিশ্বাস করেন।
সুতরাং বুদ্ধিমানের কাজ হবে অভিযোজনের অংশ হিসেবে সৌর জিওইঞ্জিনিয়ারিংয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করা। এটি গ্রিনহাউস গ্যাস ও উষ্ণায়নের বিপরীতে হয়তো প্রকট ও শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া সরবরাহ করতে পারবে না, তবে তাপমাত্রার তুলনায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কিছুটা কমিয়ে আনতে পারে, সম্ভাব্য বৃষ্টিপাতের ধরনেও আনতে পারে পরিবর্তন।
অবশ্য বিগত ১৫ বছরের গবেষণায় দেখা গেছে, সৌর জিওইঞ্জিনিয়ারিং গ্রিনহাউস উষ্ণায়নের ফলে সংগঠিত ক্ষয়ক্ষতির উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করতে পারে।
তবে এ জাতীয় পরিকল্পনা কীভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে, যেন শুধু এটা ব্যবহারকারী দেশই নয়, বরং তাদের মাধ্যমে প্রভাবিত হতে পারে এমন দেশের জন্যও পরিকল্পনাটি উপযোগী হয়, এ বিষয়ে রয়েছে যথেষ্ট ধোঁয়াশা।
বিভিন্ন দেশ তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী এই প্রযুক্তির ব্যবহার করতে চাইবে। তবে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে একই সময়ে এক দেশ উপকৃত হতে পারে, আবার অন্য দেশ ক্ষতিগ্রস্ত। তবে ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ কমানোর বিকল্প হতে পারে, এমনটা চিন্তা করা নিঃসন্দেহে বোকামির নামান্তর।
সৌর জিওঞ্জিনিয়ারিং সম্পর্কে চিন্তা করতে হলে কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে এবং এখানে সামান্য স্বার্থে যে ঝুঁকি আছে, সেটা বিবেচনায় নিয়েও এই প্রযুক্তি ব্যবহারের চেষ্টা করা যেতে পারে।
মানবজাতি যে দিন দিন কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠছে, সেটাও এখানে স্পষ্ট। লিফি নদীর পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেতে দেখে বার্ক বলেছিলেন, ‘মানুষ কতটা তুচ্ছ এই বিশালতার সামনে, তারপরও মনে মনে নিজেকে সে ভাবে কতটা বৃহৎ, সবকিছুর মনিব, যদিও সে এই বিশালতার সামনে আদেশ দিতে ভয় পায়।’
মানুষ না বুঝেই নিজের স্বার্থে জলবায়ুকে নিজের বিরুদ্ধেই ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলেছে, যার ফলে এখন পৃথিবীতে মানব পরিবেশই অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। তাই ভুলে গেলে চলবে না, মানুষ প্রকৃতিকে মানুষের স্বার্থে চলার হুকুম দিতে পারে না, বরং মানুষকেই প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী চলতে হয়।