জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে বাড়তে পারে প্রাণঘাতী ভাইরাস
মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ছড়াতে সক্ষম এমন অন্তত ১০ হাজার ভাইরাস আছে বর্তমানে। আর এরমধ্যে বেশিরভাগই অশনাক্ত, বিভিন্ন প্রাণীদেহে বাস তাদের। বেশিরভাগ সময়ই এসব রোগ মানুষ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না।
কিন্তু, কিছু ক্ষেত্রে ভাইরাস এক প্রজাতির প্রাণী থেকে অন্য প্রজাতির প্রাণীর দেহে সংক্রমিত হয়, এটি ভাইরাস স্পিলওভার নামে পরিচিত। প্রাণীদের মধ্যে এভাবে সংক্রমণ ছড়িয়ে মানুষের মধ্যেও সংক্রমিত হলে ভয়াবহ পরিস্থিতি হয়।
ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ সংক্রামক অনেক রোগের কারণ ছিল ভাইরাসের এভাবে এক প্রজাতির প্রাণী থেকে অন্য প্রজাতিতে ছড়িয়ে পড়া। ২০০২ সালে ছড়িয়ে পড়া সার্স রোগের করোনাভাইরাস বাদুড় থেকে সিভেট প্রজাতির একটি প্রাণীর শরীর হয়ে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
এর এক দশক পর, ২০১৩ সালে গিনির একটি গ্রামে ১৮ মাস বয়সী এক শিশু ইবোলা আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। বাদুড়ের বাস এমন একটি গাছের নিচে বসে খেলেছিল সে, ওই বাদুড়গুলোর দেহে ছিল এই রোগের বাস। সে সময় ইবোলার প্রাদুর্ভাবে ১১ হাজার মানুষ মারা যায়।
অন্যদিকে, আমরা কখনো কোভিড-১৯ এর আদি উৎস নিশ্চিতভাবে জানতে না পারলেও, বিজ্ঞানীদের মত, কোভিড সৃষ্টিকারী সার্স-কোভ-২ ভাইরাসেরও আদি পোষক ছিল এই বাদুড়।
উদ্বেগের বিষয় হলো, পৃথিবীর জলবায়ু উত্তপ্ত হওয়ার সঙ্গে এ ধরনের ‘ভাইরাস স্পিলওভার’ এর ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে মানুষের মধ্যে আরও হাজারো নতুন ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও বাড়ছে। গত সপ্তাহে ন্যাচার সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণায় এসব তথ্য জানানো হয়।
গবেষণায় বলা হয়েছে, এর কারণ হলো, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে খাবার ও উষ্ণ আবহাওয়ার খোঁজে নতুন বাসস্থানের খোঁজ করতে বাধ্য হচ্ছে প্রাণীরা। এরফলে, বাস্তুসংস্থানের মধ্যে প্রাণীদের একে-অপরের সংস্পর্শে আসার স্বাভাবিক নিয়ম পালটে যায়।
গবেষণাটির গবেষকরা পূর্বাভাস দিয়েছেন, ২০৭০ সালের মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লেও বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে অন্তত ১৫ হাজার নতুন ভাইরাস সংক্রমণের ঘটনা ঘটবে। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুযায়ী ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধির চরমসীমা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
গবেষণাটির দু’জন গবেষক জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল চেঞ্জ বায়োলজিস্ট কলিন কার্লসন এবং একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজিজ ইকোলজিস্ট গ্রেগ আলবেরি তিন বছর তাদের গবেষণা তত্ত্ব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। ২০১৯ সালে গবেষকরা বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে ছড়াতে সক্ষম এমন ভাইরাসগুলোর ডেটা সেট বিশ্লেষণ শুরু করেন।
তারা দেখতে পান, পৃথিবীর সব স্থানে এ ধরনের ভাইরাসের পোষক প্রজাতি স্থানান্তরের ঘটনা ঘটবে। কিন্তু, এর বড় অংশ হবে গ্রীষ্মমন্ডলীয় আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পাহাড়ি এলাকায়।
এর কারণ হলো, পাহাড়ের পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্রাণীদের নতুন বাসস্থানের সন্ধানে পাড়ি জমানোর সম্ভাবনা বেশি, কারণ জীব বৈচিত্র্যপূর্ণ নিম্নভূমির প্রাণীরা নতুন জায়গার খোঁজে উচ্চভূমির দিকে যাত্রা শুরু করে।
এ ধরনের ভাইরাস স্পিলওভার পুরোপুরি বন্ধ করা হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, বন্যপ্রাণীদের মধ্যে রোগের প্রাদুর্ভাবের নজরদারি সিস্টেম আরও জোরালো করলে বেশি সতর্ক থাকা সম্ভব হবে।
এছাড়া, কোনো সংক্রামক রোগ অতিমারি রূপে ছড়িয়ে পড়ার আগেই সংক্রমণ রোধের চেষ্টা করতে হবে। সেইসঙ্গে, কোনো রোগের প্রাথমিক প্রাদুর্ভাব মোকাবিলা করতে স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নের বিকল্প নেই বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।