জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নারীর উপর বাঁড়ছে শারীরিক ও মানসিক ঝুঁকি
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যে শুধু প্রাকৃতিক বিপর্যয়, দুর্যোগ, আবহাওয়া পরিবর্তনের মতো সব সময় ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান, এমন নয়। নারীর ওপর রয়েছে এর বহুমুখী প্রভাব। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি নারীর আর্থিক, সামাজিক, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে, যা পুরো সমাজকে প্রভাবিত করে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পুরুষের চেয়ে নারীর স্বাস্থ্যগত সমস্যা বেশি দেখা যায়। বিশেষ করে উপকূল, হাওর অঞ্চলের নারীরা বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হন। উপকূলীয় এলাকার নারীরা লবণাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে জরায়ু ক্যান্সারের মতো জটিল রোগে ভুগছেন।
এক প্রতিবেদনে বলা হয়, লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে নারীর গর্ভপাতের হার বেড়েছে। খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন উপজেলার নারীরা অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে নারীর জরায়ু রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, গর্ভকালীন খিঁচুনি, অপরিকল্পিত গর্ভপাত, এমনকি অপরিণত শিশু জন্মের হার বেড়েছে।
এ ছাড়া এ অঞ্চলের নারীরা দৈনন্দিন কাজে লবণাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে লিকোরিয়া অর্থাৎ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগসহ চর্মরোগে ভুগছেন।
উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে কাজ করছেন শরূব উইমেন্স ইউনিটের তরুণ স্বেচ্ছাসেবক হৈমন্তী মণ্ডল। তিনি জানান, ‘উপকূলে জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রায় ৫০ শতাংশ নারীর বেশির ভাগ সময় পানিতে কাটাতে হয়। তাদের উপার্জনের একমাত্র পথ মাছের ঘের, যেখানে লবণ পানির পরিমাণ বেশি।
দিনের বেশির ভাগ সময় লবণাক্ত পানিতে অতিবাহিত করার জন্য তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকির মাত্রা বেড়েছে। এ ছাড়া সচ্ছলতা না থাকায় তারা নিজের স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে পারেন না। ফলে তাদের প্রজনন স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে পড়ছে, বাড়ছে মানসিক সমস্যাও।’
তিনি আরো বলেন, ‘নারীর আর্থিক সচ্ছলতার জন্য বিভিন্ন ধরনের কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে ধীরে ধীরে এ সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব। তা ছাড়া আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায় তারা শিক্ষার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে পড়ছেন।’
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে বাদ পড়েনি হাওর অঞ্চলও। গড় তাপমাত্রার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হওয়ায় এ অঞ্চলের মানুষ নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হন। বিশেষ করে, কিশোরী ও নারী, যাদের বয়স ১২-৪৫ বছরের মধ্যে, তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি দেখা যায়।
ঋতুস্রাবের সময় থেকে শুরু করে মেনোপোজের সময় দেখা দেয় স্বাস্থ্যজনিত নানা সমস্যা। যেমন– পুষ্টিহীনতা, রক্তস্বল্পতা, অনিরাপদ প্রসব, অপরিণত শিশু প্রসব, খিঁচুনি ও অনিয়মিত ঋতুস্রাব।
সুনামগঞ্জের জলবায়ু কর্মী রিমা আক্তার কাজ করছেন ইয়ুথ অ্যাকশান ফর সোসাইটি ডেভেলপমেন্টের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। তিনি জানান, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে ফসল উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটে। এতে হাওর অঞ্চলের নারীর মধ্যে দেখা দেয় পুষ্টিহীনতা।
প্রায় সময় নারীর মধ্যে অনিয়মিত ঋতুস্রাব, জরায়ুতে সিস্ট, অসময়ে মেনোপোজসহ প্রজনন স্বাস্থ্যের নানা জটিলতা। কমিউনিটি পর্যায়ে স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা বাড়ানো এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারী ও কিশোরীর মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো গেলে এ সমস্যা কমিয়ে আনা সম্ভব।’
খুলনা মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী নাদিয়া ইসলাম বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বাড়ছে, এতে শরীরে অতিরিক্ত ঘাম হওয়ায় পানিশূন্যতা দেখা দিচ্ছে। হরমোনের তারতম্যের কারণে বিভিন্ন মানসিক রোগ যেমন- অ্যাংজাইটি, ডিপ্রেশনের শিকার হচ্ছে নারী ও কিশোরীরা।’
মেন্টাল হেলথ ফার্স্ট এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি লিড মনিরা রহমান মনে করেন, শারীরিক স্বাস্থ্য ও মানসিক স্বাস্থ্য একে অন্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নারী বা কিশোরী যখন প্রজনন স্বাস্থ্যজনিত সমস্যায় ভোগে, সে ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পরিবারে হঠাৎ আর্থিক বিপর্যয় নেমে আসার কারণে নারী বিষণ্নতা এবং উদ্বিগ্নতায় দিন অতিবাহিত করেছেন। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন কমিউনিটি পর্যায়ে যত স্বাস্থ্যকর্মী আছেন, তাদের প্রত্যেককে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার।
জেলা পর্যায় বা উপজেলা পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করা। মাঠ পর্যায়ে যারা কাজ করছেন, তাদের মাধ্যমে মানসিক ও প্রজনন স্বাস্থ্যের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।