জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কৃষিজমিতে হানা দিয়েছে লবণ
নোয়াখালী শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার পথ পেরোলে সুবর্ণচরের পূর্বচরবাটা ইউনিয়নের চর নঙ্গলিয়া গ্রাম। এ গ্রামকে বলা হয় ধান ও রবিশস্যের ভান্ডার। চর নঙ্গলিয়ার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সরু খাল। পাশেই পিচ ঢালা রাস্তা।
সেই সড়কের ধারে ৩০ বছর ধরে তিন একর জমিতে চাষবাস করছেন আব্দুর রহমান। ফলনও হতো ভালো। তবে এবার আমন মৌসুমে জমির মাঝখানের ধান হঠাৎ জ্বলসে যেতে দেখেন তিনি। আর মাটিতে দেখা দেয় সাদা আবরণ। আব্দুর রহমান বুঝতে পারেন, কৃষিজমিতে হানা দিয়েছে লবণ।
জমির একই হাল আশপাশের আরও অন্তত ১০ কৃষকের। তাঁরা বলেন, সুবর্ণচরের দুর্গম কিছু এলাকায় লবণাক্ততা আছে। তবে এখন ধীরে ধীরে নতুন নতুন জমিতে লবণ গ্রাস করছে।
জমিতে লবণাক্ততার মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এবার রবি ফসল ফলাতে না পারায় দুর্বিপাকে পড়ে কৃষক পরিবারগুলো। প্রকৃতির এমন বৈরিতায় টিকে থাকা নিয়ে চিন্তিত তাঁরা।
জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাবে লবণের আগ্রাসন এখন শুধু দক্ষিণাঞ্চলে নয়, ছড়িয়ে পড়ছে নতুন নতুন এলাকায়। ছড়াচ্ছেও দ্রুতগতিতে। লবণাক্ততার তীব্রতায় আবাদি জমি হয়ে পড়ছে অনাবাদি।
ফলন কমে যাওয়ায় গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক ক্ষত। কৃষি বাঁচানোর তাগিদে সরকার নতুন জাতের ধান উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে লবণের আগ্রাসন সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে।
তবে এখনও লবণসহিষ্ণু ফসলের জাতের সম্প্রসারণ সীমিত। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয় মাথায় রেখেই জাত উদ্ভাবন করতে হবে। এ পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলতে না পারলে খাদ্য নিরাপত্তা পড়বে হুমকিতে।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) গত বছরের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, শুধু লবণাক্ততার কারণেই প্রতিবছর উপকূলীয় জেলাগুলোয় খাদ্যশস্য উৎপাদন কমেছে ৩০ লাখ ২৭ হাজার টন। ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ ৮ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ‘ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্ল্যান অব বাংলাদেশ (২০২৩-২০৫০)’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের দক্ষিণের ১৯ জেলার চাষযোগ্য জমির প্রায় অর্ধেকই লবণাক্ততায় ডুবে আছে। ২০০০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত নতুন করে লবণাক্ততার মুখে পড়েছে ৩৫ হাজার ৪৪০ হেক্টর জমি।
এমন পরিস্থিতিতে স্থানভিত্তিক ও জলবায়ুসহিষুষ্ণ জাত উদ্ভাবনে গুরুত্ব দিয়ে গবেষণা করছেন বিজ্ঞানীরা। এর মধ্যে রয়েছে খরা, বন্যা, লবণসহিষুষ্ণ, জিঙ্কসমৃদ্ধ, গোল্ডেন রাইসসহ উচ্চফলনশীল জাত।
গত ১৩ বছরে বৈরী পরিবেশ সহনশীলসহ মোট ৬৯০টি উন্নত ও উচ্চ ফলনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জাতের মধ্যে আছে- লবণাক্ত সহনশীল ১৪টি, জলমগ্নতা সহনশীল ৬টি, জলমগ্নতা ও লবণাক্ত উভয় সহনশীল ২টি, খরা সহনশীল ১০টি, জোয়ার-ভাটা সহনশীল ৩টি, ঠান্ডা সহনশীল ৪টি, প্রিমিয়ার কোয়ালিটির ৭টি ও হাইব্রিড ধান ৬টি।
জনগণের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশ্বের প্রথম জিঙ্কসমৃদ্ধ ব্রি ধান-৬২সহ ৭টি জিঙ্কসমৃদ্ধ জাত ও প্রিমিয়াম গুণসম্পন্ন রপ্তানিযোগ্য ১৩টি, অ্যান্টি অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ ধান, ডায়াবেটিক ধান এবং প্রো-ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ গোল্ডেন রাইসের জাত উদ্ভাবন হয়েছে।
তবে এসব জাতের ধানের উৎপাদন কৃষকের চাহিদা পূরণ করতে পারেনি। মোট উদ্ভাবনের ১০ শতাংশ জাতও মাঠে কৃষকের কাছে এখনও যায়নি।
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক ড. জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস বলেন, নতুন জাত উদ্ভাবন ও জলবায়ু তহবিল সংগ্রহে গুরুত্ব না দিলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন কঠিন হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন ও দ্রুত সম্প্রসারণ করতে হবে। মাঠে যেসব জাত রয়েছে এর ফলন ২০ শতাংশ কম।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নিয়াজ মো. ফারহাত রহমান বলেন, আগে কৃষকরা অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে ফসল আবাদ করতেন, এখন বিরূপ আবহাওয়ায় ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন।
সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে ওয়েদার স্মার্ট প্রযুক্তির বাস্তবায়ন প্রয়োজন। এ উদ্যোগের নাম হবে আবহাওয়ার পূর্বাভাসভিত্তিক ধান উৎপাদন ব্যবস্থাপনা যা ইন্টিগ্রেটেড রাইস অ্যাডভাইজরি সিস্টেম (আইআরএএস)। এর মাধ্যমে উৎপাদন খরচ ১৫ শতাংশ কমবে, আয় বাড়বে ৩০ শতাংশ।
কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, জলবায়ুসহিষুষ্ণ নতুন জাতের ফসল উদ্ভাবন ও গবেষণায় গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। অনেক জাত উদ্ভাবন হলেও অল্প কিছু ছাড়া বাকিগুলো মাঠে নেই। উদ্ভাবিত জাত ছড়িয়ে দিতে কাজ করছি।