জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ব্যাহত হচ্ছে খাদ্য উৎপাদন, বাড়ছে খাদ্যের দাম
বিশ্বজুড়ে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ব্যাহত হচ্ছে খাদ্য উৎপাদন ও মূল্যনির্ধারণ। তাপপ্রবাহ, খরা, বন্যা বা তুষারপাতে ফসল উৎপাদন হ্রাস পাওয়া এবং দাম বাড়ার মতো একের পর এক ঘটনা ঘটছে।
যুদ্ধ ও বিভিন্ন সংক্রামক রোগও রয়েছে এর পেছনে। সম্প্রতি ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন ও চীনে শূকরের সোয়াইন ফ্লু ছড়িয়ে যাওয়ার পর বিশ্বজুড়ে দেখা গেছে এ বাস্তবতা।
তবে যুদ্ধ বা রোগের চেয়েও জলবায়ু পরিবর্তন খাদ্যের দাম বৃদ্ধিতে রেখেছে স্থায়ী ছাপ। ব্রাজিলের কমলা থেকে পশ্চিম আফ্রিকার কোকো, দক্ষিণ ইউরোপের জলপাই থেকে ভিয়েতনামের কফিতে পড়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। স্থায়ীভাবে আবহাওয়ার ধরন পরিবর্তনের ফলে ফসলের ফলন ও সরবরাহ কমে যাচ্ছে, বাড়ছে দাম।
গ্লোবাল এগ্রিকালচারাল হেজ ফান্ড ফারার ক্যাপিটালের সহপ্রতিষ্ঠাতা অ্যাডাম ডেভিস বলেন, এ বছর অনেক বেশি পরিমাণে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়িয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত গম ১৭ শতাংশ, পাম অয়েল ২৩, চিনি ৯ ও শূকরের মাংসের দাম ২১ শতাংশ বেড়েছে।
এইচএসবিসির প্রধান এশিয়া অর্থনীতিবিদ ফ্রেডরিক নিউম্যান বলেছেন, বৈশ্বিক খাদ্যের দামের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের একটি বস্তুগত প্রভাব রয়েছে। বিচ্ছিন্ন ও পৃথক ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা সহজ হলেও আমরা এ ধরনের অস্বাভাবিক ঘটনা একের পর এক ঘটতে দেখছি। এগুলো অবশ্যই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে যুক্ত করে।
নিউম্যান যুক্তি দেন এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তির ফলে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর স্থায়ী প্রভাব পড়ে। খাদ্যের মূল্য অস্থায়ী হিসাবে বাড়লেও তা ক্রমাগত মুদ্রাস্ফীতির উৎস হয়ে উঠছে।
ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংক ও পটসডাম ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট রিসার্চের সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুসারে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে আগামী দশকজুড়ে বিশ্বব্যাপী বার্ষিক খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার প্রতি বছর ৩ দশমিক ২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে।
এর অর্থ হলো ২০৩৫ সালের মধ্যে বার্ষিক সামগ্রিক মুল্যস্ফীতি ১ দশমিক ১৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে। এ গবেষণায় ভবিষ্যতের মূল্যস্ফীতির চিত্র অনুমান করতে ১৯৯৬-২০২১ সালের মধ্যে ১২১টি দেশের ডাটা ব্যবহার করা হয়েছে। দেখা গেছে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বৈশ্বিক দক্ষিণাঞ্চল।
তাই প্রশ্ন উঠেছে মুদ্রানীতি কীভাবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবে। অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকই বাজারে অস্থিরতার কারণে তথাকথিত মূল মূল্যস্ফীতি থেকে খাদ্য ও জ্বালানির দাম বাদ দেয়।
কিন্তু এখন জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে স্থায়ী মূল্যস্ফীতির চাপ সৃষ্টি হতে শুরু করেছে তাতে খাদ্যের মূল্যনির্ধারকদের আরো বেশি মনোযোগ দেয়া উচিত কিনা তা নিয়ে বাড়ছে বিতর্ক। কারণ খাদ্যের দাম বৃদ্ধির প্রভাব সাধারণ মানুষ গভীরভাবে অনুভব করছে।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের গ্রান্থাম রিসার্চ ইনস্টিটিউট অন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের পলিসি ফেলো ডেভিড বার্মস, খাদ্য মূল্যস্ফীতির বৃদ্ধিকে সাময়িক বলে উল্লেখ করেছেন।
ফ্রেডরিক নিউম্যান ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, খাদ্য সরবরাহে ঘন ঘন বাধা সৃষ্টি হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধ্য হবে। ফলে সুদহারের ওঠানামা আরো বাড়বে ও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সুদহার বেশিই থেকে যাবে।
২০১৩-১৬ সাল পর্যন্ত ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) গভর্নরের দায়িত্ব পালন করা রঘুরাম রাজন বলেন, উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে সবসময় খাদ্যের দামের ব্যাপারে বেশি প্রতিক্রিয়াশীল হতে হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ‘উন্নয়নশীল দেশগুলোকে খাদ্যের দাম আরো বেশি বিবেচনায় নিতে হয়। কারণ এটি কেবল বাজেটের একটি বড় অংশ নয়, এটি এমন একটি সর্বজনীন ঘটনা যা ক্রমান্বয়ে আরো অস্থির হয়ে উঠছে।’